আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০২১। বিজয় লাভের ৫০ বছর। বাঙালি জাতির গৌরবের দিন, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরকে আজ সারাদেশে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানানো হবে। সাড়ে ১৭ কোটি বাঙালি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করবে দেশের বীর সন্তানদের। যাদের ৯ মাসের সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের লাল সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মরণে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে ভোর থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা ও ইউনিয়নে পালিত হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি।
১৯৭১ সালের এই দিনেই যে পাকিস্তান সামরিক সরকার ও সেনাবাহিনী পরাজয় মেনে নেয়, যুদ্ধে হার মেনে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নেয়। এখন বলতে পারবে, যে দলিলে স্বাক্ষর করে পাকিস্তানিরা হার মেনেছিল, তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন কে কে? সেই দলিলেই বা কী লেখা ছিল? হ্যাঁ, আজকে চিরসত্য সেই গল্প-ই লিখবো। তার আগে, একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। আমাদেও দেশের স্বাধীনতার গল্প তো আমরা অনেক বার শুনিয়েছি। সেই গল্পটুকুই একদম সংক্ষেপে আরেকবার বলছি, দেখি তো, কার কতটুকু মনে আছে। লাল-সবুজের মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবার কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। কারণ বাঙ্গালী জাতির বুকে ভরা আত্মবিশ্বাস; ৪৯ বছরের এই বিজয়ের নিশানের দিকে। লাখো শহীদের রক্তে আর মা বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে কেনা আমাদের মাতৃভুমি। ৫০ বছরে পদার্পণ করা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার মাটিতে এখনো সেই ৩০ লাখ শহীদের রক্তঝরা দিনগুলো মনে করছেন প্রবীণদেও সাথে নবীনরাও।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাব ও স্বৈর দৃষ্টিভঙ্গীর বিরূদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল মজলুম নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৯ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নিবার্চনে বিজয় এবং ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি-কপ প্রতিষ্ঠা ছিল পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরূদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদেও নেতৃত্বমূলক আন্দলোনের মাইলফলক। পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধিকারের প্রশ্ন ১৯৫০-এর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে। ১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণাটি প্রকৃষ্ট হতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় দায়ের করা হয়। ১৯৬৯-এ আইয়ূব খানের পতন হয়, তবে সামরিক শাসন অব্যাহত থাকে। সামরিক সরকারের অধীনে ১৯৭০-এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে এবং একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তও থেকে বিরত থাকেন।
পূর্ব পাকিস্তান (১৯৪৭-১৯৭১) ছিল পাকিস্তানের পূর্ব অঙ্গ যা ১৯৭১-এ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময়কে পাকিস্তান আমল হিসাবে পরিচিত ছিল। মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয়, যার ফলে মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল গড়ে ওঠে। তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল প্রধানত পূর্ব বঙ্গ নিয়ে, যা বর্তমানের বাংলাদেশ।
এবার চলে আসি কিভাবে ভাষার লড়াই তার একটি সারসংক্ষেপ..১৯৫০ সালে ভূমি সংস্কারের অধীনে ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত জমিদার ব্যবস্থা রদ করা হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব সত্তে¡ও পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংঘাতের প্রথম লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পায়। পরবর্তী দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে নানা পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় চড়াই, উৎরাই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে মায়ের ভাষার লড়াই গুরুত্ব পায়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক নতুন সূর্য উধিত হয় ১৯৫২’র মহান ২১ ফেব্রুয়ারীর। যদিও আরও বিশেষ দিন রয়েছে ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে কিন্তু সময় আর ইতিহাস বলে ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারী অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা অর্থনৈতিক শোষনের শিকার হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগন ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে তৎকালীন মুসলীম লীগ সরকারের উপর। তার প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৪ সালের ৮ই মার্চ অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দীর নেতৃত্বে গঠিত মোর্চা যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে। স্বায়ত্বশাসন থেকে বঞ্চিত করা হয় পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের জনগনকে।
১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবিস পেশ করেন। ছয় দফার দাবির মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তান হবে একটি ঋবফবৎধষ বা যৌথরাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ঋবফবৎধঃরড়হ বা যৌথরাষ্ট্রের প্র্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ন স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। পরবর্তীতে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। এই আন্দোলনকে শিথিল করার উদ্দেশ্যে সরকার মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। এবং পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো কিছু বাঙালি সেনা, নৌবাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের পদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্টদ্রোহিতার অভিযোগ এনে একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এই মামলার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারন করে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করেন। কিন্তু তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান এই দাবি অগ্রাহ্য করে আন্দোলনকারীদের উপর দমনপীড়ন শুরু করেন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় প্রাণ হারান ছাত্রনেতা আসাদ, কিশোর মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা সহ আরো অনেকে। এই সকল ঘটনায় সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি পেলে ২২শে ফেব্রুয়ারী সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অবশেষে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ২৪ শে মার্চ তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলে বিক্ষোভের অবসান হয়।
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং ১৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের ৫টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। উভয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের সর্বমোট ৩০০ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন অধিকার করে। অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮ আসন অধিকার করে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চের আগে ঢাকা থেকে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়। সে রাতেই পাকিস্তান বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামের হত্যাযজ্ঞ। যদিও এই হত্যাযজ্ঞে মূল কেন্দ্রবিন্দুু ছিল ঢাকা, পুরো দেশজুড়ে বাঙ্গালী হত্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ্য। মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পাকিস্তানী হায়েনার দল লোমহর্ষক বর্বরতা চালায় ঐ মুহূর্তে। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধরনের ঠান্ডা মাথার হত্যাকান্ডের কথা অস্বীকার করেছে তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক ধরনের শক্তি প্রয়োগ করেছিলো। জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হলগুলোতে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিওটেপে ধারণ করেন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি বর্তমান বুয়েট অধ্যাপক নূর উল্লাহ। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মাম্বলবীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয় এই দেশটিতে। মধ্যরাতের আগেই, ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দু প্রধান এলাকাগুলো। ২রা আগস্ট, ১৯৭১ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু, যারা মোট শরণার্থীদের (রিফিউজি) তিন চতুর্থাংশ, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ক্রোধ ও আক্রোশ বহন করছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। শেখ মুজিব গ্রেফতার হবার পূর্বে ২৫মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ ২৬ মার্চ) টি.এন্ড.টি ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর) ওয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫শ খন্ড,পৃ:৫৬)। ২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগের অনেক প্রধান নেতা ভারতে আশ্রয় নেয়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ.হান্নান প্রথম শেখ মুজিব এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন। পরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। (সূত্র : মেজর জিয়ার বেতার ঘোষনা এবং বেলাল মাহমুদের সাক্ষাৎকার) এই সময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল অলি আহমেদ (তৎকালীন ক্যাপ্টেন)। সরাসরি সেনাবাহিনীর থেকে আহবান পাওয়ার পর সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে এবং দেশের মানুষ নিশ্চিত হয় যে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীন স্বার্বভৌম একটি দেশ আজ বিজয়ের নিশান উড়িয়ে দিয়ে আমার, আপনার ও আমাদের মতো নতুন প্রজন্মকে জানতে, শিখাতে সাহস যুগিয়েছে। আর এ ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মানচিত্রে সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে পেরেছে। যার প্রেক্ষাপটে কয়েক লাখ বাঙ্গালী আপাম জনতার রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার সূর্য উধিত হয়েছে।
বিজয়ের এই ৫০ বছরের সময়ে কেমন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস? স্বল্প কথায় বিশ্লেষণ করলে মানসপটে ভেসে উঠে জাতির পিতার নেতৃত্বে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চিত্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত পাকিস্তানের একটি প্রদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিনির্মাণে জাতির পিতার ক্লান্তিহীন চেষ্টা, বিশ্বের সব দেশের স্বীকৃতি আদায়, বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করা সবই ইতিহাস। এরপরই কালো অধ্যায়। জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মিছিল থেকে হটিয়ে ফের ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার দীর্ঘ চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর টানা ১৬ বছর চলেছে সামরিক শাসন। এরপর সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরলেও তিন মেয়াদের পরই আবার অনির্বাচিত সরকারের প্রত্যাবর্তন। সব মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের বড় একটি অংশই ছিল গণতন্ত্রের বাইরের যাত্রা। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করে সাড়ে ২১ বছর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। জাতির পিতাকে হত্যার পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকে পাঁচ বছর। মাঝে ৫ বছর বাদ দিয়ে ২০০৯ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত অর্থাৎ গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে টানা ক্ষমতায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট।
স্বাধীন বাংলাদেশের যত অর্জন, তার প্রায় সবকিছুই এসেছে এই ২১ বছরে, আওয়ামী লীগের হাত ধরে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে দীর্ঘ ২১ বছর পরিচয় পাওয়া বাংলাদেশ অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার এক যুগ ধরে দেশের মানুষসহ গোটা বিশ্ব দেখছে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সফলতার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ম্যাজিক। ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থাকা শেখ হাসিনা শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ পরিচালনা করছেন, অর্জন করেছেন বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ে নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ পরিচালনার রেকর্ড। সব মিলিয়ে আজ বাংলাদেশ গোটা বিশ্বে এক মর্যাদার নাম।
আজকের দিনটি বাঙালি জাতির গৌরবের দিন, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন-মুক্ত ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। বিজয়ের ৫০ বছরেও সেই নরপশুদের বিচার হচ্ছে। সত্যি অন্যরকম স্বাধ, অভিপ্রায় যে রাষ্ট্রনামক যন্ত্রটি তাঁর নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বিজয়ের উল্লাসের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। সত্যিই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন আর পরাধীন নয়।
লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক