ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনীতির মাঠে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলো এখন পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বে একদিকে আছে বিএনপি; আরেক দিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই দুই শিবিরের মধ্যে স্লোগান ও কথার ‘যুদ্ধ’ যেমন চলছে, পাশাপাশি বক্তৃতা-বিবৃতিতে পরস্পরের সমালোচনায়ও তারা সোচ্চার। সাম্প্রতিক সময়ে এসব স্লোগান-বক্তৃতা রাজনৈতিক শালীনতা বা শিষ্টাচারেরও সীমা অতিক্রম করছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও ক্ষমতার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এই কাদা–ছোড়াছুড়ি বাড়ছে। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিপরীতে একটি নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার প্রচেষ্টা চলছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলন বা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের কেউ কেউ ভেতরে-ভেতরে দুই শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে বলে জানা গেছে। দলগুলোর মধ্যে এমন বিভেদের জেরে ফ্যাসিবাদী শক্তির ফিরে আসার পথ তৈরি হয় কি না, সে আশঙ্কার কথা বলছেন বিভিন্ন দলের নেতারা।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত মঙ্গলবার চারটি ও পরদিন বুধবার ১৩টি দল ও জোটের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, এক বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তাই মতপার্থক্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যকে আরও দৃশ্যমান করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংস্কারকেন্দ্রিক বিভিন্ন ইস্যুতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির সঙ্গে বিএনপির মতভিন্নতা রয়েছে। জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের দাবি, আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন। অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। দলটি বলছে, নির্বাচনের জন্য জরুরি সংস্কারকাজ শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক। বিএনপির নেতাদের সন্দেহ, নতুন নতুন ইস্যু, অজুহাত বা পরিস্থিতি তৈরি করে একটা মহল নির্বাচন পেছাতে চায়।
এই মতভিন্নতা থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি বনাম জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের একধরনের বাগ্যুদ্ধ চলে আসছিল কিছুদিন ধরে। ৯ জুলাই পুরান ঢাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই দুই শিবিরের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও স্লোগানের ‘যুদ্ধ’ শিষ্টাচার ছাড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় নেতাদের লক্ষ্য করে ব্যক্তি আক্রমণও শুরু হয়। ৯ জুলাই ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘বিএনপির কী গুণ, ৯ মাসে দেড় শ খুন। চাঁদা তুলে পল্টনে, চলে যায় লন্ডনে।’ এ কথা বলার পর তিনি এ–ও বলেন, ‘এটা আমি বলছি না কিন্তু, পাবলিকে বলে।’ এর আগের দিন নাটোরে এক সমাবেশে ফয়জুল করীম ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক গাছের দুই ডাল, দুই ফল’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
পুরান ঢাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে নৃশংসভাবে হত্যার ভিডিও ভাইরাল হয় ১১ জুলাই। এ নিয়ে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ওই দিন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রকাশ্য দিবালোকে মাথায় পাথর মেরে শত শত মানুষের সামনে এই হত্যার ঘটনা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। তিনি পরদিন বলেছেন, ‘চাঁদা না পেয়ে যুবদলের সন্ত্রাসীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’ এই ঘটনায় বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কয়েকজনের সম্পৃক্ততার খবর বের হলে সংগঠন থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়।
এই খুনের প্রতিবাদে ১১ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ইডেন মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে মিছিল বের হয়। এসব মিছিলে উচ্চারিত স্লোগানে বিএনপিকে আক্রমণ করা হয়। বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে স্লোগান দেওয়া হয়।
যেমন ‘যুবদল খুন করে, তারেক রহমান কী করে’। কিছু স্লোগান অশালীন ছিল। এসব মিছিলের নেপথ্যে বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল বলে দলটির নেতারা মনে করেন।
বিএনপির নেতারা এসব বক্তব্য ও স্লোগানকে পরিকল্পিত রাজনৈতিক আক্রমণ বলে আখ্যা দেন। ১৩ জুলাই বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, ‘দু-একটি দল বিএনপিকে টার্গেট করছে।’ অবশ্য বিএনপির দিক থেকেও পাল্টা স্লোগান দেওয়া হয় তখন। যেমন ‘দিল্লি গেছে স্বৈরাচার, পিণ্ডি যাবে রাজাকার।’ এ ছাড়া চরমোনাই পীরকে লক্ষ্য করে দেওয়া অশালীন স্লোগানও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছিল।
লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপানোর ষড়যন্ত্র চলছে বলে ১৪ জুলাই নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস মন্তব্য করেন। তিনি এ জন্য জামায়াত, চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির সমালোচনা করেন। তিনি চরমোনাই পীরকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি ধর্মীয়ভাবে কোথা থেকে পাস করেছেন?’ জামায়াত সম্পর্কে বলেন, ‘নিজের পায়ে জোর নেই। একসময় এরশাদের, পরে আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করেছেন। এখন বিএনপি নিয়ে কথা বলছেন।’
বিএনপির এই নেতা ১৮ জুলাই আরেক কর্মসূচিতে বলেন, ‘একজন পীর সাহেব একসময় বলেছিলেন, জামায়াতের ছোঁয়া যেখানে লাগবে, তা পচে যাবে। এখন তিনি জামায়াতের কোলে বসেছেন।’ ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের হামলা ও দিনভর সহিংসতার ঘটনার পর ধারণা করা হয়েছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বাগ্যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত হবে। কিন্তু সেটা আর হয়নি। উল্টো বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে লক্ষ্য করে এনসিপির নেতার ব্যক্তি-আক্রমণাত্মক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
২০ জুলাই কক্সবাজারে এনসিপির পথসভায় দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আগে শামীম ওসমান ছিল নারায়ণগঞ্জে, এখন কক্সবাজারে গডফাদার এসেছে শিলং থেকে।’
এই বক্তব্যের পর সালাহউদ্দিন আহমদের নির্বাচনী আসন চকরিয়ায় এনসিপির সভামঞ্চ ভাঙচুর করেন বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। বিএনপি বনাম অন্য তিন দলের মধ্যে দূরত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ইসলামী আন্দোলন (২৮ জুন) ও জামায়াতের (১৯ জুলাই) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশে অন্য দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
অবশ্য জামায়াতের সমাবেশে শফিকুর রহমান অসুস্থ হলে মির্জা ফখরুল তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান। যদিও এই রাজনৈতিক সৌজন্য বিভেদ কমানোর ক্ষেত্রে খুব একটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন না বিশ্লেষকেরা। বিএনপির উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পরে প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন হোক, বিভাজনের সংস্কৃতি তৈরি হোক, এমনটা আমরা চাইনি। এমন বাংলাদেশ চেয়েছি, যেখানে সবাই মিলে এসব ঘটনার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবে।’ তাঁর মতে, পুরান ঢাকার হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিএনপিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি মীর্জা গালিব মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কারণে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক দিন পর গণতান্ত্রিক স্পেস (মতপ্রকাশের জায়গা) পেয়েছে। সে কারণে সবাই নিজেদের মতো করে কথা বলছে। কিন্তু ‘টোন হাই’ করে ফেললে এটা খারাপ দিকে যাবে বলে মনে করেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মৌলিক সংস্কারের কিছু প্রস্তাবের বিষয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির যে মতপার্থক্য, সেটাকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে কিছুটা চাপের মধ্যে ফেলেছে অন্যরা। বিএনপি সংস্কারবিরোধী বা নির্বাচনের জন্য অস্থির হয়েছে, তাদের সম্পর্কে এমন একটা প্রচার বা ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। যার জেরে সুযোগ পেলেই দলগুলোর নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য, মন্তব্য করে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এখন একদিকে বিএনপি, অন্যদিকে কয়েকটি দল, এমন রাজনীতি দেখা যাচ্ছে। নানা বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোর মতপার্থক্য থাকায় বিএনপি কিছুটা চাপের মধ্যে পড়ে গেছে বলে মনে হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে দায় চাপানোর চর্চা গ্রহণযোগ্য নয়। এই চর্চার ফলে রাজনীতিবিদদের পরস্পরের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি ও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এতে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা দায়িত্বশীল আচরণ এবং যথাযথ রাজনৈতিক চর্চা করবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।