এই মুহূর্তে অনেকেই মনে করছেন বিএনপি আগামী নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে দেশ শাসন করবে। ভাবনাটা হয়তো বিএনপির নেতা–কর্মীদের মধ্যে একধরনের উচ্ছ্বাসের জন্ম দেয়, ও বিরোধীদের মধ্যে উষ্মা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো বিএনপির জন্য এই রাজনীতি এত সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এমনকি একটা গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার যে আশা, তা খুব সহজে অর্জিত হবে বলে মনে হচ্ছে না। আসুন দেখি এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ সংকট কী?
বিএনপির এখন প্রধান সংকট হলো বিএনপির জনপ্রিয়তা। আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় দল বলে প্রতীয়মান হয়। এই জনপ্রিয়তাই বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে যথেষ্ট। অর্থাৎ যেহেতু বিএনপি বড় দল, তেমনি বিএনপির ওপর মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে আমরা আরনেস্তো লাক্লাউয়ের পপুলিস্ট ডিমান্ড বা জনতুষ্টিবাদী দাবি ধারণাটি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি।
বিএনপি এখন একটি ‘ফাঁকা সংকেতবাদী চিহ্ন’ (যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছামতো নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিস্থাপন করতে পারে) হয়ে উঠছে। আর এই প্রত্যাশাকেই বিএনপির বিরোধী শিবির রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। রাজনীতিতে এটা খুব স্বাভাবিক। ফলে ধরুন বিএনপির যেকোনো নেতার অপকর্মের দায় পার্টি হিসেবে বিএনপিকে বহন করতে হচ্ছে। বিএনপি গত ৯ মাসে ৪ হাজারের বেশি নেতা–কর্মীকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বহিষ্কার করেছে।
অন্য দলগুলো নিজেদের কর্মীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে কী ব্যবস্থা নিয়েছে কিংবা কতজনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা কিন্তু আমরা খুব একটা জানি না। কিন্তু বিএনপির বিরোধী গোষ্ঠী এটা বেশ ভালো করেই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে দেশে যা অন্যায় ও অপকর্ম হচ্ছে, সব দায় বিএনপির কর্মীদের (বিএনপির বহু নেতা–কর্মী যে অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তবে এই ক্ষেত্রে এই কর্মীদের পুলিশ ও বিচারের আওতায় আনার থেকে এই নিয়ে রাজনীতি বেশি হয়ে থাকে বলেই মনে হয়)।
বিএনপির দ্বিতীয় সংকট হলো বিএনপির কোন নেতার আসলেই জনসমর্থন আছে, তা আসলে বিএনপি নিজেই নিশ্চিত নয়। একটু আশ্চর্য লাগছে, তাই না? আসুন ব্যাপারটা এভাবে ভেবে দেখি। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিন নির্বাচনের দুইটিতে বিএনপি অংশ নেয়নি, কেননা, এতে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। এর ফলে আওয়ামী লীগে যেমন হাইব্রিড নেতারা শুধু সংসদের টিকিট কিনে নেতা হয়েছেন, তেমনি বিএনপির কোন নেতার পেছনে কত লোকের জনসমর্থন আছে, তা বিএনপি নেতৃত্বের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। এর একমাত্র গ্রহণযোগ্য উপায় হলো নির্বাচন। তো এর ফলে কি হয়েছে?
বিএনপি এই পাঁচ সংকট কেমন করে মোকাবিলা করে, তার ওপর বিএনপির রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করবে বলেই মনে হয়। বিএনপি যদি আগামী ১০ বছর অন্তত পাবলিক ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ শাসন করতে চায়, তবে বিএনপিকে পার্টির আধুনিকায়নের দিকে নজর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
এতে বিএনপির সব পর্যায়ে এমন নেতৃত্ব ‘ব্লক’ তৈরি হয়েছে, যারা মনে করে তাদের পেছনে জনসমর্থন আছে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার কোনো নির্বাচনী উপাত্ত আমাদের নেই। এর ফলে পার্টির ভেতরের ক্ষমতার এই ছোট ছোট ব্লকগুলো যখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে চাপ দেয়, তখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই ক্ষমতা ব্লকগুলোর জনসমর্থনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কেননা, সেই তথ্য নেই। তখন তারা ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
এই প্রক্রিয়া পার্টিকে দুর্বল করে দেয় ও পার্টির মধ্যে গঠনতন্ত্র ভাঙার ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতা বিস্তারের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। বাস্তবতা হলো যদি জাতীয় নির্বাচন না হয়, তবে এই প্রবণতা বেড়ে যাবে ও বিএনপি চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এ হিসাব বিএনপির বিরোধীরা ঠিক ভালো করেই জানে। অর্থাৎ এই দুর্বলতা বিএনপির বিরোধী ব্লক রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক, অর্থাৎ নির্বাচনকে বারবার পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।বিএনপির তৃতীয় বড় সমস্যা হলো সংস্কার নিয়ে বিএনপির বাস্তববাদী অবস্থান। এই ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক বাস্তববাদ বুঝতে হবে। যেহেতু বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, সেহেতু তাদের ওপর দায়িত্ব পড়বে সংস্কার বাস্তবায়ন করা। অন্যদিকে বিএনপির বিরোধী পক্ষ, যারা সংস্কারের প্রায় সব বিষয়ে একমত (কিছু বিষয়ে দ্বিমত আছে, তবে তা গৌন), কেননা, তারা আপাতত ক্ষমতায় যাচ্ছে না ও তাদের আপাতত হারানোর কিছু নেই।
বরং সব সংস্কার বাস্তবায়ন হলে তারা বিরোধী দল হিসেবে ক্ষমতার একটা বড় ভাগ পাবে, তবে সরকারের ব্যর্থতার দায় তেমন নিতে হবে না, যা নিতে হবে বিএনপিকে। অন্যদিকে বিএনপির চিন্তা, কিছু সংস্কার প্রস্তাব এমনভাবে করা, যা মানলে আগামী নির্বাচিত সরকার অনেকটা দুর্বল আকারেই কাজ করতে বাধ্য হবে, যেমন এনসিসি গঠন। আর এখানেই রাজনীতি। এখন যদি বিএনপি অনেক সংস্কারে ভেটো দেয় এবং নির্বাচনের জন্য জোর করে, সেই ক্ষেত্রে অন্য দলগুলো, যেমন জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, চরমোনাই পীরের দল ও অন্যান্য ইসলামি ব্লক মিলে যদি নির্বাচন বয়কট করে ও নির্বাচন প্রতিহত করার হুমকি দেয়, তবে বিএনপির আসলে কিছু করার নেই।
এখন যদি ইসলামপন্থী ব্লকগুলো নির্বাচন বয়কট করে, তবে বিএনপি কি একা একা নির্বাচন করবে? আবার এই একই ব্লকগুলো যদি নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করে, তবে কি সরকার শক্তি প্রয়োগ করে নির্বাচন করবে? আমার মনে হয় না সরকার তা করবে। এই ঘটনা হলো সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। আমি বলছি না এমন হবেই, তবে আমরা এমন অনেক লক্ষণ রাজনীতিতে দেখতে পাচ্ছি। তো মোদ্দাকথা হলো বিরোধীদের কাছে ব্ল্যাকমেল করার অস্ত্রও আছে, বিএনপির কাছে নেই। এটাই বাস্তবতা। তাই বিএনপিকে ছাড় সব থেকে বেশি দিতে হচ্ছে। এখানে জনতুষ্টিবাদী আলাপ না করে খাঁটি রাজনীতির দিক থেকে দেখতে হবে।
বিএনপির আরেকটি সংকট হলো বিএনপির ২০০৬ সালের পর থেকে কোনো গভর্নিং মেমরি (শাসনের স্মৃতি) নেই। আরেকটু বিস্তারিত বলি। যেকোনো রাজনৈতিক দল যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশ শাসন করতে গিয়ে দেশ শাসনের কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে ও পার্টির ভেতরে গভর্নিং মেমরি তৈরি হয়। এটা পার্টির ভেতরে একটা দক্ষ গ্রুপ তৈরি করে, যা দেশ শাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ২০০৬ সালের পর থেকে প্রায় ১৯ বছর বিএনপির কোনো গভর্নিং মেমরি তৈরি হয়নি, অন্যদিকে দেশের শাসন বাস্তবতা বাস্তবতা পাল্টে গেছে।
এই নতুন বাস্তবতায় গভর্নিং মেমরি ছাড়া যে কাঠামোগত দুর্বল সরকার ভবিষ্যতে তৈরি হবে, তার সাফল্যের সম্ভাবনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আপাতত সংবিধান সংস্কারের সব প্রস্তাব যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে নিঃসন্দেহে আগামী দিনে আমরা একটা দুর্বল সরকার পাব, যার কাজে প্রতিনিয়ত বিরোধীরা বাগড়া দেবে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে যেকোনো ব্যর্থতার দায় সরকারের, এই ক্ষেত্রে বিরোধীদের কোনো দায় থাকে না। এই কারণেই এখানে বিরোধী দলের রাজনীতি সহজ।
বিএনপির আরেকটি সংকট হলো ক্ষুব্ধ তরুণেরা। আমরা অনেকেই চোখ বন্ধ করে আছি, কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের আশপাশেই এই ক্ষুব্ধ তরুণেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা যা চান, তা পান না, আর যা পান, তা চান না। এই চাওয়া–পাওয়ার দ্বন্দ্ব তাঁদের মধ্যে যে আগুন তৈরি করেছে, তা জুলাই আন্দোলনের সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এই আগুন থেকে গেছে ও ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, কেননা, দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতা বাড়েনি, কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা বেড়েছে। এই প্রত্যাশাই বিএনপির গভর্নিংয়ের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
কারণ, বিএনপি যখন ক্ষমতায় যাবে, তখন তাকে মোকাবিলা করতে হবে জামায়াত ও এনসিপির শক্তিশালী অনলাইন উপস্থিতি, ইসলামপন্থীদের মাঠের ক্ষমতা, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক চাপ। আর এই ত্রিমুখী চাপে পড়ে বিএনপি কী করবে, তার ওপর নির্ভর করবে বিএনপির ভবিষ্যৎ। বাস্তবতা হলো শাসনে বিএনপি তার এককালের মিত্র ও বর্তমানের বিরোধী শক্তিগুলোর কোনো সমর্থন পাবে না। কেননা, বিএনপিকে প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানের মোকাবিলা করতে হবে। প্রশ্ন হলো বিএনপি তা পারবে কি না?
বিএনপি এই পাঁচ সংকট কেমন করে মোকাবিলা করে, তার ওপর বিএনপির রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করবে বলেই মনে হয়। বিএনপি যদি আগামী ১০ বছর অন্তত পাবলিক ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ শাসন করতে চায়, তবে বিএনপিকে পার্টির আধুনিকায়নের দিকে নজর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
অন্যদিকে কিছু সংকটের ক্ষেত্রে বিএনপির তেমন কিছু করার নেই ধৈর্য ধরা ছাড়া, যেমন বিরোধীরা যদি নির্বাচন বয়কট করে। আসলে এই সংকটগুলোর কোনো সহজ সমাধান নেই। তাই আমরা বলতেই পারি বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোনোভাবেই সহজ হবে না। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কতটা প্রস্তুত?
আসিফ বিন আলী বর্তমানে জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করছেন