প্রশাসন বিএনপির পক্ষাবলম্বন করছে বলে এনসিপি যে অভিযোগ করেছে তা সঠিক নয়, এমন মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ ধরনের দাবি অনভিজ্ঞতা এবং অপরিপক্বতার বহিঃপ্রকাশ। এটা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রেখে নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশলমাত্র। এ ধরনের বক্তব্যের বাস্তব কোনো ভিত্তিও নেই। রাজনীতি চর্চার বয়স ও অভিজ্ঞতা দুটির ঘাটতি আছে এনসিপির অনেক নেতার। বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের আরও কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন সাবেক সচিবরা। তারা বলেন, প্রশাসনে এখনো আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মাঠ প্রশাসন পুরোটাই আওয়ামীপন্থিদের দখলে। কাজেই প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের অভিযোগ অবান্তর ও অযৌক্তিক। প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়, প্রশাসন বিএনপির পক্ষে-এমন বক্তব্যে ফ্যাসিবাদের দোসরদের ফেরার পথ তৈরি হয়। এনসিপির আহ্বায়কের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেন।
বুধবার বাংলাদেশে সফররত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় এশিয়া ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিকোল এন চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। প্রশাসন মাঠপর্যায়ে নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। প্রশাসন বিভিন্ন জায়গায় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষাবলম্বন করছে। মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজি চলছে অথচ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা বলছি এ ধরনের প্রশাসন থাকলে তাদের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসন, পুলিশ এবং আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে।
জনপ্রশাসন নিয়ে কথা বলার আগে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়ার জন্য এনসিপি নেতাদের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, গত ১৫-১৬ বছর দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। এ সময় মাঠ থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশাসনের সব পর্যায়ে তাদের মতাদর্শী কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে। এছাড়া প্রায় দেড় যুগ আগে নিয়োগপ্রাপ্তরা এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। এদের কেউ বিএনপিপন্থি হওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমান সরকার আসার পর কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এরপরও প্রশাসনের নেতৃত্বে আছেন ফ্যাসিবাদের দোসররাই। তবে পরিবর্তনের ফসল হিসাবে সম্প্রতি কিছু পদে আওয়ামীবিরোধীরাও বসেছেন। আওয়ামীবিরোধী মানে বিএনপিপন্থি এটা ভাবা ঠিক হবে না। এদের সবাইকে বিএনপিপন্থি বলার মানে ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছাড়ার সুযোগ করে দেওয়া। যদি বলা হতো আওয়ামী লীগ মতাদর্শের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন তাহলে সেটা অনেকাংশে সত্য হতো। সেটা না বলে বিএনপিকে চাপে রাখার মতো করে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। যা দেশের স্বার্থবিরোধী একটি চক্র চাচ্ছে। যে কোনোভাবে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত চক্রটি। এজন্য তাদের হাত শক্তিশালী করতে অনেকের ওপর ভর করছে। এই চক্রের ফাঁদে কোনোভাবেই পা দেওয়া যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা এনসিপি নেতাদের সাবধান করে দেন।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, এনসিপির এ ধরনের অভিযোগের বাস্তব ভিত্তি নেই। তারা এসব বলে বিএনপিকে চাপে রাখতে চায়। এটা বিএনপিকে চাপে রাখার রাজনৈতিক কৌশল। তিনি আরও বলেন, তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তারা বয়সে তরুণ হওয়ায় তাদের অভিজ্ঞতারও ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি তারা আরও ভেবেচিন্তে বিবৃতি দেবেন। তাদের বক্তব্যের কারণে ফ্যাসিবাদের সমর্থক আমলাদের ফেরার পথ প্রশস্ত হচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নে সাবেক এই সচিব বলেন, আপাতত তাদের ফেরা প্রায় অসম্ভব।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান যুগান্তরকে বলেন, নাহিদ ইসলাম প্রশাসন নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে তারা কিছু দিন আগে বলেছেন প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের দোসরদের দৌরাত্ম্য চলছে। এখন বলছে প্রশাসন বিএনপির পক্ষাবলম্বন করছে। আমরা কোনটা সত্য ধরে নেব। তারা এসব বক্তব্যের মাধ্যমে নির্বাচন বিলম্ব করতে চায়। তবে দেশের মানুষ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আস্থা রাখতে চান। তিনি যে সময়ে নির্বাচন দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন হোক গণমানুষ তাই প্রত্যাশা করে। দেশের কল্যাণে সময়মতো একটি নির্বাচন হওয়া জরুরিও বটে।
আবু আলম শহীদ খান আরও বলেন, নাহিদ ইসলামের বক্তব্য সঠিক নয়। কারণ বিএনপি তো দেশ পরিচালনা করছে না। দেশ পরিচালনা করছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সুতরাং প্রশাসন বিএনপির পক্ষ নেওয়ার দাবি ধোপে টেকে না। আর যদি প্রশাসন বিএনপির পক্ষ নিয়েও থাকে তাহলে তো এ দায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর বর্তায়। বিএনপির ওপর নয়। সুতরাং এসব বাত কি বাত। এসব বলে তারা নির্বাচন বিলম্ব করার চেষ্টা করছেন বলে দেশের মানুষ মনে করেন।
সাবেক সচিব মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, এনসিপির আহ্বায়কের বক্তব্য ভিত্তিহীন ও অবাস্তব। এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে তারা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখতে চায়। এটা তাদের রাজনীতির কৌশল হতে পারে। তিনি আরও বলেন, মাঠ প্রশাসন নিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক অভিযোগ করেছেন অথচ মাঠ প্রশাসনে বিসিএস ২৫ এবং ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা হিসাবে প্রশাসনে পরিচিত। ২৭তম ব্যাচ আওয়ামী লীগের তালিকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। মাঠ প্রশাসনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবং মাঠের অন্যান্য পদবির ক্যাডার কর্মকর্তারা ২০০৯ সালের পর ফ্যাসিবাদের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। সুতরাং মাঠ প্রশাসন বিএনপির পক্ষাবলম্বন করছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা মোটেই সত্য নয়।
সাবেক এই সচিব আরও বলেন, বর্তমানে সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৭৬ কর্মকর্তার ৫০ ভাগও বিএনপি-জামায়াতপন্থি অফিসার নন। বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনাররাও বিএনপি-জামায়াতপন্থি নন। বরং তারা আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা। এখনো অনেক আওয়ামীপন্থি অফিসার কর্মরত। বরং বিএনপি-জামায়াতপন্থিদের পরিকল্পিতভাবে প্রশাসন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাদের দাবি অবাস্তব ও অবান্তর। এসব কল্পণাপ্রসূত দাবির মাধ্যমে তারা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখতে চায়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফোন দেওয়া হলে আক্তার হোসেন নামে এক ব্যক্তি ফোন ধরে যুগান্তরকে বলেন, আমি এখন নাহিদ ভাইয়ের কাছে নেই। আপনি মুন্তাসির মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। মুন্তাসির মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, আমি নাহিদ ইসলাম স্যারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং তার সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাব। ২ ঘণ্টা পর ফোনে মুন্তাসির যুগান্তরকে বলেন, আমি বিষয়টি নাহিদ ইসলাম স্যারকে বলেছি। তিনি বলেছেন, বুধবার প্রশাসন নিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা পাঠানো হবে। কবে এ ব্যাখ্যা গণমাধ্যমে পাঠাবেন-এমন প্রশ্নে মুন্তাসির বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) অথবা আগামীকাল (শুক্রবার) দিতে পারেন।