নির্মাতার নাম যখন রাজ কাপুর, তখন তাঁর সিনেমায় সাহসী দৃশ্য থাকবে না, তা কি হয়! তবে ১৯৭৮ সালে ‘সত্যম শিবাম সুন্দরম’ মুক্তির পর বিতর্কটা মাত্রা ছাড়ায়। সেটা এতটাই যে দেব আনন্দ সরাসরি সিনেমাটির সমালোচনা করেন, গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে নির্মাতার দূরত্বও তৈরি হয়। কী হয়েছিল সেই সময়ে? সে গল্প জানতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় তিন দশক।
আলোচনায় বিতর্কিত দৃশ্য
বলিউডের সোনালি যুগে খুব কম নির্মাতাই রাজ কাপুরের মতো সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ সেই সাহসিকতারই এক নিদর্শন। ছবির নায়িকা জিনাত আমান, ‘রুপা’ চরিত্রে অভিনয় করে যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, তেমনি বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। ছবির ‘সাইয়াঁ নিকাস গায়ে’ গানটির দৃশ্যেই মূল বিতর্কের সূত্রপাত। এটি ছিল ছবির বিয়ের রাতের দৃশ্য, যেখানে জিনাত আমান ও শশী কাপুরকে দেখা যায়। রাজ কাপুর এ দৃশ্য সাহসী ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছিলেন। জিনাত আমানের পোশাক ও ভঙ্গিমা সে সময়ের দর্শকদের কাছে ছিল অস্বাভাবিকভাবে খোলামেলা। বিশেষত একটি মুহূর্তে তাঁকে প্রায় উন্মুক্ত অবস্থায় দেখা যাওয়ায় অনেকে ক্ষুব্ধ হন। মামলা ও সমালোচনা
ছবিটি মুক্তির পর সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। রাজ কাপুরের বিরুদ্ধে হিমাচল প্রদেশের এক ব্যক্তি মামলা করেন। অভিযোগ, ছবিটি অশালীন ও নামের মধ্যেই অশালীন আভাস আছে। অনেকেই রাজ কাপুরের বিরুদ্ধে নারীর শরীরকে ‘আধ্যাত্মিকতা’ ও ‘নির্মলতার’ আড়ালে ব্যবহার করার অভিযোগ তোলেন।
লতা মঙ্গেশকর ও রাজ কাপুরের দূরত্ব
ছবির গানগুলো গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর, কিন্তু সংগীত পরিচালকের বিষয়ে মতবিরোধে তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়। এমনকি অভিনেতা-নির্মাতা দেব আনন্দও ছবিটির সমালোচনা করে বলেন, রাজ কাপুর নারীর সৌন্দর্যকে ‘অতিরিক্ত রোমান্টিক’ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। বিতর্কের মধ্যেই সাফল্য
সব সমালোচনা সত্ত্বেও ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য পায়। সময়ের সঙ্গে এটি বলিউডের অন্যতম প্রতীকী ও সাহসী সিনেমা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়।
‘খুবই সংযত’
জিনাত আমান এখনো সাক্ষাৎকার দিতে গেলে কথা বলতে হয় ‘সত্যম শিবাম সুন্দরম’ সিনেমা নিয়ে। বছর কয়েক আগে ইনস্টাগ্রামে অভিনেত্রী নিজেই লিখেছিলেন সিনেমাটি নিয়ে। জিনাত লেখেন, ‘ছবির চুম্বন দৃশ্য নিয়ে হুলুস্থুল হয়েছিল, তবু তা ছিল খুবই সংযত।’ পোস্টটিতে জিনাত শেয়ার করেছেন ছবির একটি দৃশ্য, যেখানে দেখা যায় তাঁর ও শশীর প্রথম পর্দার চুম্বন দৃশ্য। জিনাত লিখেছিলেন, ‘আমি এই ক্লিপ শেয়ার করলাম দুটি কারণে। প্রথমত, এটি আমার ক্যারিয়ারের একটি বড় মুহূর্ত ছিল—প্রথম অনস্ক্রিন চুমু। তখন এটা নিয়ে প্রবল হইচই হয়েছিল, কিন্তু আসলে দৃশ্যটা খুবই সংযত ছিল। শুটিংয়ের সময় একটুও অস্বস্তি লাগেনি আমার। দ্বিতীয়ত, কারণ, সেই স্কুলছাত্রী জিনাত এই পোস্ট দেখে নিশ্চয়ই খুশি হতো—ভাবতেও পারেনি, তার স্বপ্নের মানুষটির সঙ্গে একদিন সিনেমায় কাজ করবে!’
স্কুলে এসেছিলেন শশী
জিনাত জানান, শশী কাপুরকে তিনি প্রথম দেখেন মহারাষ্ট্রের পানচগনির বোর্ডিং স্কুলে। তখন অভিনেতা তাঁর থিয়েটার দল ‘শেক্সপিয়ারানা’ নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতে এসেছিলেন। ‘তিনি ছিলেন প্রত্যেক স্কুলছাত্রীর স্বপ্ন! সবার ক্রাশ। মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি আমাদের মোহিত করে দিয়েছিল,’ লিখেছেন জিনাত।
‘শুধু একঝলক দেখার অপেক্ষায় থাকতাম’
মুম্বাইয়ে অভিনয়ে নামার আগেও শশী কাপুরকে নিয়ে জিনাতের মোহ কাটেনি। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের বাসার কাছেই থাকতেন শশী কাপুর। শোনা গিয়েছিল, তিনি প্রতিদিন বিকেল ছয়টায় হাঁটতে বের হন। আমি আর আমার বান্ধবীরা প্রতিদিন হাঁটতে যাওয়ার অজুহাতে বের হতাম শুধু তাঁকে একঝলক দেখার আশায়!’
একসঙ্গে একাধিক ছবিতে কাজ
পরবর্তী সময়ে শশী কাপুর ও জিনাত আমান পরে একসঙ্গে কাজ করেছেন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, ‘রোটি কাপড়া ওউর মকান’, ‘চোরি মেরা কাম’, ‘বকিল বাবু’সহ একাধিক ছবিতে। জিনাত লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, রসিক ও দারুণ এক মানুষ। খুব উষ্ণ হৃদয়ের ছিলেন, তাঁর হাসি ও কথায় চারপাশের সবাই প্রাণ পেত।’
সোনার কয়েনে শুভেচ্ছা
এর আগের জিনাত আমান জানিয়েছিলেন, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এ তাঁকে কাস্ট করার পর রাজ কাপুরের স্ত্রী কৃষ্ণা কাপুর তাঁর হাতে একমুঠো সোনার কয়েন তুলে দিয়েছিলেন শুভেচ্ছা হিসেবে।
রাজ কাপুরের বক্তব্য
সাংবাদিক বীর সাংঘভি তাঁর আত্মজীবনী ‘আ রুড লাইফ’-এ লিখেছেন, সিনেমার সেটের জিনাতের কিছু ছবি যখন প্রকাশিত হয়, তখন তা মিডিয়ায় হুলুস্থুল সৃষ্টি করে। অনেকেই ছবিগুলোকে ভারতের দর্শকের জন্য উপযোগী নয় বলে মনে করেছিলেন।
বীর উল্লেখ করেন, মুম্বাইয়ের আরকে স্টুডিওতে এক আলোচনায় রাজ কাপুর ছবিটি দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, কে কীভাবে বিষয়টি দেখেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। জিনাতের চরিত্রের সংবেদনশীল দৃশ্যগুলো নিয়ে রাজ বলেছেন, ‘যাঁরা জিনাতের শরীর দেখতে আসবেন, তাঁরা বের হয়ে আমার ছবির কথা মনে রাখবেন।’
দেব আনন্দের কণ্ঠে ক্ষোভ
‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ তখন দেব আনন্দের ‘দেশ পরদেশ’-এর সঙ্গেই মুক্তি পায়। ছবিটি দেব আনন্দের ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসা ক্যারিয়ারকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। তবে দেব আনন্দ রাজ কাপুরের সাফল্যে খুশি ছিলেন না। বীর সাংঘভির স্মৃতিতে, দেব আনন্দ বলেছিলেন, ‘এটি একটি অশ্লীল ছবি। ক্যামেরা বারবার জিনাতের শরীরের ওপর কেন্দ্রীভূত হচ্ছে? অশ্লীল!’