শহুরে মেসজীবনের নানা টানাপোড়েন, হাসি-কান্না, প্রেম, বন্ধুত্ব ও খুনসুটি নিয়ে ২০১৮ সালে প্রচারিত হয় ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’–এর প্রথম সিজন। ধারাবাহিকটির এখন পঞ্চম সিজন চলছে। এই ধারাবাহিকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান পলাশ, সবাই তাঁকে কাবিলা নামে এখন চেনে বেশি। পলাশ বলেন, ‘বাংলাদেশে এত ইউটিউব চ্যানেল, এত টেলিভিশন, এত কনটেন্ট—তারপরও মানুষ একটা কনটেন্টকে আলাদা করে মনে রাখছে। শুধু আমারটাই না, প্রতিটা চরিত্র মানুষ মনে রাখছে।’
কথা প্রসঙ্গে পলাশ বললেন, ‘এই নাটক মানুষের মন ও আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। মানুষ মনে করে, এখানে তাদের কথা বলছে, জীবনে ফেলে আসা কোনো একটা অনুভূতির কথা বলছে। মানুষ সহজে এটার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারে। ব্যাচেলর পয়েন্টের সাফল্যের এসব বড় একটা কারণ।’
হঠাৎ অভিনয়ে
অভিনয়ে আসার পরিকল্পনা পলাশের মাথায় ছিল না। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে অভিনয়ের চক্করে পড়েন। তখন তিনি ইশতিয়াক আহমেদ রোমেলের সহকারী। ২০১৫ সালে ‘কারসাজি’ ধারাবাহিকের কাজ চলছিল। একটি চরিত্রে রোমেল টুকটাক অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। পরে কাজল আরেফিন অমির সঙ্গে সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করলেন। বানালেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যেটিতে অভিনয় করলেন পলাশ। নাম ঠিক না হওয়া সেই ছবিটি মুক্তি পায়নি। পরে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ ধারাবাহিকে অভিনয় পলাশকে আলোচনায় নিয়ে আসে। পলাশ বললেন, ‘একজন নির্মাতাকে অভিনয়ও জানতে হয়। অভিনয়শিল্পীকে অভিনয়টা বুঝিয়ে দিতে হয়। অভিনয়ের একধরনের অভ্যাস আমার মধ্যে ছিল। অমি ভাই এই দিকটা মানুষের কাছে তুলে ধরেন। অভিনয়ে আসাকে ত্বরান্বিত করেছেন।’
কলেজজীবনে সহকারী পরিচালক
ঢাকার নাখালপাড়ায় পলাশের বেড়ে ওঠা। পরিচালক (বর্তমানে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা) মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বাড়ির পাশেই ছিল পলাশদের বাড়ি। ফারুকীর বাড়ির নাম ছিল ‘একান্নবর্তী’, পলাশের কর্ণফুলী হাউস। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকে ফারুকীর প্রতি মুগ্ধতা।
পলাশ বললেন, ‘আমার পড়ার টেবিলের পাশের জানালা থেকে ফারুকীর ভাইয়ের বাসার ছাদ দেখা যেত। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম, ফারুকী ভাইকে দেখতাম শুটিং করছেন। সহকারীদের সঙ্গে কথা বলছেন। দেখতাম, একজন পরিচালক হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর পেছনে অনেক মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন, মনে হতো হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা। বাহ্, ডিরেক্টরদের ব্যাপারস্যাপার তো অন্য রকম। সে যা বলে, শুটিংয়ে তা হচ্ছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁর দিকে তাকায়ে আছে। একটা অন্য রকম ব্যাপার। সরয়ার ভাই আমাকে মনের মধ্যে নির্মাতার বীজ বপন করে দেন। নাখালপাড়ায় যখন ৪২০ শুটিং হয়, তখন একটা দিন বাদ যায়নি, যেদিন শুটিংয়ে থাকতাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। তাঁর সহকারীদের যখন কিছু লাগত, দৌড়ে গিয়ে বলতাম, আমি ম্যানেজ করে দিচ্ছি। ’
তারপর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের পাট চুকিয়ে শুরু হয় কলেজজীবন। সময়টা তখন ২০১২ সাল। তখনই সহকারী পরিচালক কাজ শুরু করেন পলাশ।
শুটিংয়ে নস্টালজিয়া
আর আজ দেশের নানা প্রান্তে শুটিং করছেন পলাশ। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর শুটিংয়ে ভিড় জমান অনেকে, তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। পলাশ বলেন, ‘এসব দেখলে সেই সব দিনের কথা মনে হয়, নস্টালজিক হই। ওদের মাঝে একজন পলাশকে দেখি।’ আড়ম্বরপূর্ণ জীবন তাঁকে টানে না, ধীরস্থির জীবনযাপন পছন্দ করেন। দ্রুত কিছু পাওয়ার তাড়া তাঁর নেই জানালেন পলাশ। এই কারণে তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। খুব প্রিয় একটা লাইন ‘জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজনবোধ করি না।’ পলাশ আরও জানান প্রিয় কয়েকজন কবির নাম—ইমতিয়াজ মাহমুদ, পাবলো নেরুদা এবং সমসাময়িকদের মধ্যে জুনায়েদ ইভান। এ ছাড়া অভিনয়ের বাইরে মারজুক রাসেলের ভাবনার জগৎ তাকে মুগ্ধ করে এবং তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন।
মায়ের নীরব সমর্থন, বাবার আশঙ্কা
জিয়াউল হক পলাশের পরিবারের কেউ কখনো বিনোদন অঙ্গনে কাজ করেননি। বাবা মুজিবুল হক চাইতেন ছেলেও তাঁর মতো প্রকৌশলী হোক, গৃহিণী মা ফাতেমা আক্তার ছিলেন নীরব সহযোগী। পলাশ ছোট থেকেই সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। প্রথমবার এসএসসিতে ফেল করলেও পরেরবার পাস করেন। শুরুতে বাবা-মায়ের শঙ্কা থাকলেও গোপনে তাঁকে সমর্থন করতেন মা, রাতের বেলা বাবার কাছে মিথ্যা বলে টাকা নেওয়া হতো, যা পলাশের বালিশের নিচে রাখা হতো। আজ বাবা-মা পলাশের সাফল্যে গর্বিত। গত বছর ওমরাহ সফরের সময় বাবার মুখে সবচেয়ে উজ্জ্বল হাসিটা দেখেছেন তিনি। সৌদি আরবে বাঙালিরাও তাঁকে চেনেন, ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন। বাবা তাঁকে সততা ও নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়েছেন, ‘তুমি যে পেশায় আছ, সৎ থাকতে হবে।’ পড়াশোনা ও সহকারী পরিচালনার কাজ একসঙ্গে চালিয়ে গেছেন পলাশ। এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করে তিতুমীর কলেজ থেকে ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। পরিচালক হিসেবে প্রথম নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যা এখনো মুক্তি পায়নি। ২০১৮ সালে প্রথম নাটক ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট পরিচালনা করেন, এরপর আরও ১০–১৫টি নাটক। ভবিষ্যতে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখছেন পলাশ। তিনি জানান, দুই-তিন বছরের মধ্যে প্রথম সিনেমার কাজ শুরু করতে চান।