বান্দার নামাজের জন্য অপেক্ষারত দৃশ্য দেখে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সঙ্গে এমন দৃশ্যের কথা গর্ব করে বলতে থাকেন। আমরা সাধারণত গর্ব করে কোনো কথা বলি! যেটা আমাদের কাছে অনেক বেশি পছন্দ। তেমনি নামাজের জন্য অপেক্ষায় থাকা আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক বেশি পছন্দনীয়। সে জন্য তিনি তা নিয়ে গর্ভ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। এরপর কত লোক চলে গেলেন এবং কতক রয়ে গেলেন। এ সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্রুতবেগে এলেন যে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হয়ে গেল। তিনি তাঁর দুই হাঁটুর ওপর ভর করে বসলেন এবং বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের রব আসমানের একটি দরজা খুলে দিয়েছেন এবং তিনি ফেরেশতাদের কাছে তোমাদের বিষয়ে গর্ব করে বলছেন, তোমরা আমার এসব বান্দার প্রতি তাকাও, তারা এক ফরজ আদায় করার পর অন্য ফরজের জন্য অপেক্ষা করছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৮০১)
ঈমান আনার পর বান্দার যেসব মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়, তার অন্যতম হচ্ছে নামাজ। যার নামাজ যত সুন্দর হবে, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক তার তত মজবুত হবে। এ জন্য কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। নামাজের খুঁটিনাটি সব বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।
যাতে করে বান্দা তার প্রভুর সঙ্গে নিবিড় সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা চান বান্দা তার রবের সঙ্গে এই নামাজের মাধ্যমে বন্ধনকে দৃঢ় করুক। নামাজের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করুক। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ।
আমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। সুতরাং আমার ইবাদত করো এবং আমার স্মরণার্থে নামাজ কায়েম করো।’ (সুরা : তহা, আয়াত : ১৪)
নামাজের জন্য অপেক্ষা ইবাদত
বান্দা নামাজের মাধ্যমে তার প্রভুকে স্মরণ করে। দুজন নিরালায় কথা বলে।
নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রবের স্মরণেই কেটে যায়। আল্লাহর সঙ্গে কথা বলে নামাজ শেষে বান্দা আনন্দ ও মুগ্ধ হয়ে যায়। নামাজের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে রবের দরবারে পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দেয়। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই ইবাদতের
জন্য অপেক্ষা করাও ইবাদত।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘…আমার রব আমাকে বললেন, ঊর্ধ্বলোকের অধিবাসীদের মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? আমি বললাম, উচ্চ মর্যাদা লাভ ও গুনাহের কাফফারাসমূহের বিষয়ে।
আর জামাতের দিকে হেঁটে যাওয়া, কষ্টের সময়েও পরিপূর্ণভাবে অজু করা, এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। যে ব্যক্তি এগুলোর হেফাজত করবে, তাতে অবিচল থাকবে, তার জীবন হবে কল্যাণময় আর মৃত্যুও হবে কল্যাণময়। আর মাতৃ উদর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো গুনাহ থেকে সে পবিত্র হয়ে যাবে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩২৩৪)
অপেক্ষাকারী রাত জেগে ইবাদতকারীর মতো
এক নামাজের পরে অন্য নামাজের প্রতীক্ষায় থাকা এবং নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেলে নামাজ আদায়ের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে যাওয়া সাধারণ কোনো মানুষের অভ্যাস নয়, বরং যার ভেতরে নামাজের গুরুত্ব রয়েছে নামাজের মুহূর্ত রয়েছে সে-ই এমন প্রতীক্ষায় থাকে। হাদিসে এসেছে যারা নামাজের জন্য অপেক্ষা করে তারা রাত জেগে ইবাদতকারীর মতো।
উকবা ইবনে আমির (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন, যখন কোনো লোক পবিত্র হয়ে মসজিদে আসেন, তারপর নামাজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, তখন তাঁর উভয় লেখক (ফেরেশতা) অথবা তাঁর লেখক মসজিদের দিকে প্রতি কদমের জন্য ১০টি করে পুণ্য লেখেন। আর যে বসে অপেক্ষা করে সে যেন নামাজ আদায়ে রত ব্যক্তির মতো। বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত ওই ব্যক্তি নামাজে রত বলে লিখিত হয় (পুরো সময় সে নামাজ পড়ার সওয়াব পায়)। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭৪৪০)
আমাদের অনেকের অভ্যাস, জামাতের অল্প কয় মিনিট আগে মসজিদে যাওয়া। একটু বেশি আগে মসজিদে চলে গেলে কেমন যেন ছটফট করতে থাকি। মনে হচ্ছে এসে সময় নষ্ট করতেছি, কিংবা কোনো কাজ হচ্ছে না, অহেতুক সময় নষ্ট হচ্ছে। অথচ হাদিসে এসেছে, নামাজের জন্য অপেক্ষা করা নামাজে থাকার মতোই।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির নামাজ তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখে, সে নামাজে রত আছে বলে গণ্য হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫৯)
এ কারণে বিধান হচ্ছে, নামাজের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় কেউ যেন মসজিদে বসে দুই হাত মিলিয়ে না রাখে- অর্থাৎ এক আঙুলকে অন্য আঙুলের ভেতর ঢুকিয়ে না রাখে। কেননা সে তো এক ধরনের নামাজের ভেতরেই আছে। কাব ইবনে উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন উত্তমরূপে অজু করে মসজিদের উদ্দেশে বের হয়ে যায়, তখন যেন সে তার হাতের আঙুল একটির ফাঁকে আরেকটি প্রবেশ না করায়। কারণ সে তো নামাজেই আছে। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৬)
ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকেন
নামাজের উদ্দেশ্যে অপেক্ষারত ব্যক্তির জন্য ফেরেশতারা নামাজ আদায় করা পর্যন্ত মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকেন। এ জন্য আমাদের উচিত নিজের যাপিত জীবনের অভ্যাস এমনভাবে বানিয়ে নেওয়া যে প্রত্যেক নামাজেই জামাতের বেশ কিছুক্ষণ আগে যেন নামাজের অপেক্ষার জন্য কিছু সময় বরাদ্দ থাকে। অনেকে মসজিদে গিয়ে বসে থাকতে হবে, তাই ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় বের হই। অথচ একটু খেয়াল করে দু-এক মিনিট আগে বের হলে কত বড় ফজিলত লাভ করতে পারি। আমাদের মা-বোনেরা সুন্নত পড়ে ফরজ আদায়ের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি। আসলে নামাজের অপেক্ষায় থাকা জামাতের অপেক্ষা করার দ্বারা হৃদয় আল্লাহমুখী হয়। অন্তর নরম হতে থাকে। মনের ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভূত হবে। এরপর নামাজ আদায় করলে নামাজে খুশুখুজু পূর্ণরূপে পাওয়া যাবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যতক্ষণ তার নামাজের স্থানে থাকে তার অজু ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য ফেরেশতারা এই বলে দোয়া করেন যে ইয়া আল্লাহ! আপনি তাকে মাফ করে দিন, ইয়া আল্লাহ! আপনি তার ওপর রহম করুন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫৯)
গুনাহ মাফ হয়
নামাজের জন্য অপেক্ষাকারী ব্যক্তির গুনাহ মাফ হতে থাকে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের ওই বস্তুর কথা বলে দেব না, যে বস্তু দ্বারা আল্লাহ তাআলা (বান্দার) গুনাহসমূহ মুছে দেন এবং তার মর্যাদা উঁচু করে দেন? (তা হচ্ছে এই) কষ্টবোধের সময় পূর্ণরূপে অজু করা, মসজিদের দিকে নামাজের উদ্দেশ্যে গমনাগমন এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের অপেক্ষায় থাকা। আর এটিই (হলো) রিবাত, এটিই রিবাত, এটিই রিবাত (সীমান্ত প্রহরায় সর্বদা সজাগ ও প্রস্তুত থাকা)। (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস : ৩৭৩)