বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবলে প্রথমেই কয়লা, গ্যাস বা সৌরশক্তির কথা মনে পড়ে। বরফের কথা কখনো মাথায় আসে? এবার বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী কৌশলের কথা জানিয়েছেন, যার মাধ্যমে বরফ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। নতুন এক গবেষণায় স্পেনের বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, সাধারণ বরফকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বাঁকানো হলে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ইলেকট্রনিক সেন্সর তৈরিতে ব্যবহৃত বিশেষ সিরামিক পদার্থের মতোই শক্তিশালী। টাইটানিয়াম ডাই–অক্সাইড ও স্ট্রোনটিয়াম টাইটেনেটের মতো শক্তির বিদ্যুৎ দেখা যায়।
বিজ্ঞানীরা এই প্রভাবকে ফ্লেক্সো–ইলেকট্রিসিটি নাম দিয়েছেন। সহজ কথায় বলতে গেলে, এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো অপরিবাহী বস্তুকে অসমভাবে বাঁকানো বা মোচড়ানো হলে তাতে বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি হয়। এটি পিয়েজোইলেকট্রিসিটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে বস্তুকে সমানভাবে চাপ দিলে বা টানলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ফ্লেক্সো–ইলেকট্রিসিটিতে বস্তুর ভেতরের গঠন বা ক্রিস্টাল স্ট্রাকচার কেমন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
স্পেনের বার্সেলোনার কাতালান ইনস্টিটিউট অব ন্যানোসায়েন্স অ্যান্ড ন্যানোটেকনোলজির বিজ্ঞানী সিন ওয়েন এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বরফের একটি পাত তৈরি করে সেটিকে ধাতব পাতের মধ্যে রেখে নির্দিষ্ট উপায়ে বাঁকান। বরফ যত বেশি বাঁকানো হয়, তত বেশি ভোল্টেজের বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী ওয়েন বলেন, ‘আমরা দেখেছি, বরফ যেকোনো তাপমাত্রায়ই যান্ত্রিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি করে। বরফ তার কঠিন অবস্থায় থাকা পর্যন্ত অর্থাৎ গলে যাওয়ার আগপর্যন্ত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করতে পারে। এই আবিষ্কারের ফলে বরফ এখন টাইটানিয়াম ডাই–অক্সাইডের মতো উন্নত ইলেকট্রনিক উপাদানের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে বলে বলা যায়। এসব ডাই–অক্সাইডের মতো উপাদান সেন্সর ও ক্যাপাসিটর তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।’
একই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আকাশে বজ্রপাত কেন হয়, তা নিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন। বজ্রঝড়ের সময় মেঘের ভেতরে ছোট ছোট বরফের কণা ও গ্রাউপেল নামক নরম শিলাবৃষ্টির কণার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ফলে কণাগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক চার্জের আদান–প্রদান হয় বলে বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। নতুন গবেষণাটি সেই তত্ত্বের সঙ্গে ফ্লেক্সো–ইলেকট্রিসিটি প্রক্রিয়াকে যুক্ত করেছে। যখন বরফের কণা অসমভাবে বাঁকে বা মোচড় খায়, তখন ফ্লেক্সো–ইলেকট্রিসিটি একটি অতিরিক্ত পথ তৈরি করে, যার মাধ্যমে কণাগুলোর মধ্যে চার্জের স্থানান্তর ঘটে। এই পদ্ধতি বজ্রপাতের সময় সংঘটিত চার্জ স্থানান্তরের পরিমাণের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই আবিষ্কার বজ্রপাতের প্রক্রিয়াকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে ঝড়ের এমন একটি পর্যায়ে যখন জলীয় বাষ্প, বরফের কণা ও শিলাবৃষ্টির কণাগুলো একে অপরের সঙ্গে বিশৃঙ্খলভাবে সংঘর্ষ ঘটানোর সময় ফ্লেক্সো–ইলেকট্রিসিটি প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নেচার ফিজিকস সাময়িকীতে গবেষণার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।