ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক, আজনিউজ২৪: কয়েক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনে আরবদের বসবাস। যুগে যুগে এই পুণ্যভূমিতে প্রেরিত হয়েছেন বহু নবী-রাসুল। তাঁদের সমাধিস্থলও এর আশপাশেই অবস্থিত। গাজা ফিলিস্তিনের একটি বিশিষ্ট অঞ্চল। গাজা থেকে মাত্র দুই মাইল উত্তরে কিবুটস নামক এলাকা। ১৯৩০-এর দশকের কথা। পোল্যান্ড থেকে এসে কয়েকটি ইহুদি পরিবার কিবুটস এলাকায় বসবাস শুরু করে এবং ওই এলাকায় তারা কৃষি খামার গড়ে তোলে। আরবরাও তখন কৃষিকাজে অভ্যস্ত ছিল। তাই পরস্পর মিলেমিশে কৃষিকাজের মাধ্যমে উভয় জাতি বসবাস করতে শুরু করে। ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলছিল। সরল ফিলিস্তিনিরাও নির্দ্বিধায় তাদের স্থান দেয়। কিন্তু খুব শিগগির ১৯৩০-এর দশকেই ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারল যে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের জমি হারাচ্ছে। এরই মধ্যে ইহুদিরা দলে দলে সেখানে আসতে থাকে এবং জমি ক্রয় করে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।
মূলত ইউরোপীয়দের একটি দুরভিসন্ধি ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগাচ্ছিল। ইউরোপীয়রা ইহুদিদের তাদের আশপাশে থাকা কোনোভাবেই পছন্দ করত না। তাই তারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি উপনিবেশ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিল। ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটি তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। ফলে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আসতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। প্রসিদ্ধি আছে, তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে একত্র হতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনি আরবরা ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।
১৯১৭ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব ছিল তুরস্কের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য তারা সহায়তা করবে। ব্রিটেনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি ‘বেলফোর’ ডিক্লারেশন হিসেবে পরিচিত। ইহুদিরা তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। ব্রিটেনের সহায়তায় সে অনুযায়ী তারা কাজ এগিয়ে নেয়। ইহুদিদের দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ায় ব্রিটিশ সরকার। তখন ফিলিস্তিনি আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব সংঘাতময় হতে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনি আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল ব্রিটিশ সেনা ও ইহুদি নাগরিকরা। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ ব্রিটিশরা কঠোর হস্তে দমন করে। এতে আরব সমাজে ভাঙন সৃষ্টি হয়। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে ব্রিটেন হিটলারের নািস বাহিনীর বিরুদ্ধে মধ্যেপ্রাচ্যে তাদের অবস্থান জোরালো করতে চেয়েছিল। সে জন্য আরব ও ইহুদি দুই পক্ষকেই হাতে রাখার রাজনীতি শুরু করে ব্রিটেন।
১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছিল, পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য মাত্র ৭৫ হাজার ইহুদি অভিবাসী আসতে পারবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে। এর বেশি আসতে পারবে না। ব্রিটেনের এ ধরনের পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি ইহুদিরা। তারা একসঙ্গে ব্রিটেন ও হিটলার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করে। তখন ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়। পরে তারাই আরব ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। আর জেরুজালেম থাকবে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে। জাতিসংঘ বিভিন্নভাবে অন্যায় করেছে। আরবদের রাষ্ট্রে ইহুদিদের ভাগ দিয়েছে। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। এ ছাড়া আরবদের দেশ ফিলিস্তিনের রাজধানী তাদের না দিয়ে সংঘাত চালু রাখার ষড়যন্ত্র করেছে। তাই আরবরা স্বভাবতই জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদিরা স্বাধীন ভূখণ্ডের ঘোষণা পেয়ে তারা বিজয় উল্লাস করে। তখন থেকেই ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। আরবদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। ছিল না যোগ্য নেতৃত্ব। আরব দেশগুলো ছিল বিলাসিতায় মগ্ন। এ সুযোগে ইহুদিরা তাদের বিচক্ষণতা ও কৌশলে এগিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে ইহুদি সশস্ত্রদের নৃশংস হামলায় বহু ফিলিস্তিনি আরব তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। প্রায় সাত লাখের মতো লোক তখন বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। তারা আজও বাড়ি ফিরতে পারেনি। ইসরায়েল অংশে যেসব ফিলিস্তিনি বসবাস করে আসছিল, তাদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। পদে পদে নিজ ভূমিতেই নির্যাতিত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। ইসরায়েল রাষ্ট্র জন্মের ঘোষণা মাত্রই মিসর, ইরাক, লেবানন, জর্দান ও সিরিয়া যৌথভাবে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করে। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। জাতিসংঘ ইসরায়েলের পরাজয় আঁচ করতে পেরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। বিরতির সুযোগে ইহুদিরা শক্তি সঞ্চয় করে। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে প্রচুর আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে। নতুন করে তারা আরবদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইসরায়েলিরা। তেল আবিব ও জেরুজালেমের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। জাতিসংঘের মাধ্যমে আরেকটি যুদ্ধবিরতি আসে। ইসরায়েলিরা বুঝতে পারে তারা একটি ভূখণ্ড দখল করেছে ঠিকই, কিন্তু লড়াই এখনো থামেনি। তবে ১৯৪৮ সালের পর থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অতি দ্রুত উন্নতি লাভ করে যাচ্ছে ইসরায়েল।
বর্তমান সংঘাতের কারণ
রমজান ১৪৪২ হিজরি পুলিশের বাড়াবাড়ি এবং আদালতের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কয়েকটি পরিবারকে উত্খাতের বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় নতুন সংঘাত। এ ছাড়া জেরুজালেম এলাকার ফিলিস্তিনি কিশোর-তরুণদের সঙ্গে কট্টর ইহুদি সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে হাতাহাতির বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে রমজানের শুরুতে জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের ওপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ এবং আল আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশি অভিযান, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা ইত্যাদি কারণে সংঘাত বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে।
ফিলিস্তিন নির্যাতনের করুণ ইতিহাস
ফিলিস্তিনি আরবরা চরম হতভাগ্য জীবন যাপন করছে। ১০০ বছর ধরে চলছে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, বর্বর পাশবিক হামলা। নিজেদের ভূখণ্ডে দখলদার ইহুদিদের হাতে প্রতিনিয়ত তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ইসরায়েলের চলমান প্রেক্ষাপটে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নারী, শিশু ও অসহায় মানুষ হতাহতের কোনো গণনাই নেই। আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ী ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। তাদের ঘরবাড়ি ফিরে পাওয়া তাদের যৌক্তিক অধিকার। যুদ্ধবিরতির নামেও আন্তর্জাতিক মহল থেকে চলে ষড়যন্ত্র। যখন ইসরায়েলের পরাজয়ের সম্ভাবনা ঘনিয়ে আসে, তখন আন্তর্জাতিক মদদদাতারা যুদ্ধবিরতির জন্য মায়াকান্না শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যুদ্ধবিরতির আহবান করছে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিচ্ছে। এমন কাণ্ড ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র ও ভয়ংকর ধোঁকাবাজির নামান্তর। গাজার মতো অত্যন্ত ঘনবসতি একটি জনপদে নির্বিচারে বোমা হামলা খুবই উদ্বেগজনক, হতাশাজনক ও মর্মান্তিক বিষয়। মানবতা সেখানে বিপন্ন হচ্ছে পদে পদে। নিজেদের ভূমিতে নিজেদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে চরমভাবে।