ডাঃ এস.এম. জিয়াউল হক রাহাত: সুস্থ্য, সবল ও মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজাত খাদ্যের ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রাণিজাত খাদ্যের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি প্রাণিসম্পদ সেক্টরের উপর বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ তৈরী করেছে। তাই একদিকে উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি করতে হবে অপরদিকে পরিবেশের উপর কোন বিরুপ প্রভাব যাতে না পরে সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। বিশ্বব্যাপী মোট কৃষিজ উৎপাদনের একটি বড় অংশআসেপ্রাণিসম্পদ খাত থেকে । শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এর পরিমাণতুলনামূলক বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর পরিমান কিছুটা কম হলেও তা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। ২০৩০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাণিজাত পণ্যের চাহিদা দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পাবে। আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন ভ্যারাইটির খাদ্য চাহিদা বাড়ে। শষ্যজাত খাদ্যের তুলনায় গুণগত ও উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন দুধ, ডিম ও মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। মেধাবী জাতি গঠনের ক্ষেত্রে প্রাণিজ প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে বাজার, হাট, স্টেশন, রেস্তোরা, দর্শনীয় স্থান,শপিং মল, থিয়েটার, পার্ক, টুরিস্টস্পটগুলোতে বিভিন্ন দুধজাত, মাংসজাত পণ্যেরআধিক্য বেশী থাকে। মানুষও সেসব পণ্য আগ্রহ নিয়ে ক্রয় করে। কিন্তু আমাদের দেশে স্টেশন, হাট, বাজার, মেলা, শপিং মলসহ বিভিন্নদর্শণীয় স্থানগুলোতে এসকল পণ্য গ্রহণেরআগ্রহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের তুলনায় বেশ কম।এমনকি বাসা-বাড়িতেও দুধ, ডিম, মাংস সমৃদ্ধ খাবারের তুলনামূলক ব্যবহার কম। দুধ ও মাংসজাত পণ্যের দেশীয় ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হলে একদিকে যেমন মেধাবী জাতি গঠনে সহায়ক ভ‚মিকা পালন হবে তেমনি গুণগত মান ও উৎপাদন বাড়িয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ডিম, দুধ ও মাংসের জনপ্রতি চাহিদা ছিল যথাক্রমে ১০৪ টি/প্রতিবছর, ২৫০ মিলি/প্রতিদিন ও ১২০ গ্রাম/প্রতিদিন । ডিম ও মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দুধ উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে।উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত থাকলে খুব দ্রæত দুধ উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। এতে করে দুধ, ডিম, মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত প্রাণিজ পণ্য রপ্তানিমুখী খাতে পরিণত হবে।পাশাপাশি বিভিন্ন জনবহুল ও টুরিস্ট স্পটগুলোতে অন্যান্য মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি দুধ, ডিম ও মাংসজাত পণ্য বিক্রির প্রচলনও বাড়বে।সর্বোপরী দুধ, ডিম ও মাংসজাত পণ্যের চাহিদা ও উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি একটি মেধাবী ও সবল জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একসময় মাংস, ডিম, দুধ পাওয়া যেত শুধু কাচাঁ বাজারে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এগুলো বিভিন্ন সুপারশপ, অনলাইন শপে পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে বসেই মানুষ এগুলো পাচ্ছে। আমাদের দেশি ফেরিওয়ালারাও এখন ভ্যানে করে ডিম, হাঁস, মুরগী, কবুতর ইত্যাদি বিক্রি করছে। দেশে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, টার্কি, কবুতর, কোয়েল ইত্যাদির অসংখ্য খামার তৈরী হয়েছে। কমার্শিয়াল খামার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরী হচ্ছে। এখন দরকার শুধু সরকারী-বেসরকারী পৃষ্টপোষকতা। সম্প্রতিক সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে ক্ষুদ্র প্রান্তিক পর্যায়ের খামারীদের প্রণোদনা প্রদান, বিনামূল্যে হাস, মুরগী, ভেড়া, গরু, পশুখাদ্য, শেড, মেডিসিন ও ভ্যাকসিনসরবরাহ কার্যক্রম অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। অপার সম্ভাবনাময় দেশ এই বাংলাদেশ। আবহমান কাল ধরেই এ জনপদের মানুষ কৃষি ও প্রাণিসম্পদের উপর নির্ভরশীল ছিল। কালের বিবর্তনে তা আধুনিক শিল্পে রুপান্তরিত হয়েছে। মানুষ এখন অনেক স্বাস্থ্যসচেতন। প্রতিটি মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৬০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণের বিষয়ে সচেষ্ট। দুধ, দই, চিজ, ছানা, চিকেন বল, চিকেন নাগেটস, বিভিন্ন ধরণের মাংসজাত পণ্য এখন বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু নি¤œ আয়ের মানুষ এ মুখরোচক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারগুলো উচ্চমূল্যের কারণে সমভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছে না।তাই দুধ, ডিম, মুরগী ও মাংসের মূল্য সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে রাখতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অতিব জরুরী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন “আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমার মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাআল্লাহ, এই দিন আমাদের থাকবে না।” তাই ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ গড়তে প্রতিটি নাগরিকের উন্নত প্রাণিজাত পুষ্টি গ্রহণেরবিকল্প নেই। কেননা সুস্থ্য, সবল, মেধবী, কর্মক্ষম ও দক্ষ জনশক্তি ব্যতীত আমরা সামনে এগোতে পারব না। একটি মেধাবী জাতিই কেবল উন্নত, সমৃদ্ধ ওআধুনিক বাংলাদেশ গড়ার কারিগর হবে যা হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’।
প্রকল্প পরিচালক
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ।