চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘোষণা এসেছে—যার একটি হলো আগামী বছর রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, অপরটি জুলাই ঘোষণাপত্র।
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে বিতর্ক ও জনমনে সংশয় ছিল, গতকাল মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের পর তার অবসান হবে আশা করি। এই ভাষণে তিনি বর্তমান সরকারের আমলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা জানান। কীভাবে স্বৈরাচারী সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে সচল করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করেছেন—এরও বিবরণ দেন তিনি। একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রকাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপান্তরে তাঁর সরকার, বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে কঠোর পরিশ্রম করেছে, সে কথাও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার কথাও তিনি স্মরণ করেন। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে; সে ক্ষেত্রে দলগুলোর মতৈক্য ও বোঝাপড়া খুব জরুরি।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা গতকাল বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন, যাতে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথা আছে। ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি উঠেছিল অনেক আগেই। এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে; যার প্রতিফলন আমরা গণ–অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে প্রত্যক্ষ করলাম।
২৮টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত এই ঘোষণাপত্রে এই ভূখণ্ডের মানুষের ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ৯ মাসের সশস্ত্র প্রতিরোধের কথা গুরুত্বের সঙ্গেই বলা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষার কথাও।
এতে স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রের অভিযাত্রার নানা চড়াই-উতরাইয়ের বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর নব্বইয়ের দশকে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার বদলে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েমের কথা আছে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার উল্লেখ নেই।
ঘোষণাপত্রের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে নির্বাচন কমিশনকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন করতে চাই, যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য, গত তিনটি প্রহসনমূলক নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেননি; বিশেষ করে ২০০৮ সালের পর যঁারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তঁারা এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের নির্বাচনটি হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক, যাতে প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীসহ সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
এর আগে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান হলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এবার প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করেই বলেছেন, রোজার আগে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যে জুলাই সনদ সই হওয়ার কথা, সেটাও প্রায় চূড়ান্ত বলে জানান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
তবে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়; রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সহযোগিতাও আবশ্যক। জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন তথা ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে দলমত–নির্বিশেষে সবাই একযোগে কাজ করবে, এটাই প্রত্যাশিত।