অমর একুশে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জিয়াউল হকসহ ২১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির হাতে ‘একুশে পদক-২০২৪’ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেলা সাড়ে ১১টায় এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘একুশে পদক’ তুলে দেন তিনি।
অনুষ্ঠান মঞ্চে জিয়াউল হকের নাম ঘোষণার সময় উপস্থিত অতিথিরা দাঁড়িয়ে এবং করতালি দিয়ে সম্মান জানান। এ সময় তার সম্পর্কে বলা হয়,
” মোঃ জিয়াউল হক একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে জীবনসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। শুরু করেন দইয়ের ব্যবসা। এরপর সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরে এলে দই বিক্রির লভ্যাংশের টাকা দিয়ে গরিব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গরিব, অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি তিল তিল করে গড়ে তোলেন তার পারিবারিক লাইব্রেরি। একজন সাধারণ মানুষ হয়েও নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও মানবসেবায় ব্রতী হয়ে যে সাধারণ চিন্তা করেছেন তা এই সমাজে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।”
‘বেচি দই, কিনি বই’
জিয়াউল হকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার চামামুশরীভুজা গ্রামে। দই বেচে তিনি এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে গৌরব অর্জন করেছেন। ‘বেচি দই, কিনি বই’ স্লোগানের রূপকার এ মানুষটি কেবল শিক্ষার আলো ছড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন সমাজসেবায়।
জানা গেছে, জিয়াউল হক লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। পরিবারের অভাব ঘুচাতে স্কুলের পথ আর মাড়ানো হয়নি। নেমে পড়েন দুধ বিক্রিতে। কিন্তু মনের মধ্যে স্কুলে না যাওয়ার আক্ষেপটা থেকেই যায়। আর তাইতো পরিশ্রমের মজুরি থেকে এলাকার গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বইসহ অন্যান্য উপকরণ কিনে দিতেন। এভাবে শিক্ষার আলো ছড়ানো শুরু করেন মানুষটি। গড়ে তোলেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’।
স্থানীয়রা জানান, মরহুম তৈয়ব আলী মোল্লা ও শরীফুন নেসা দম্পতির ছেলে জিয়াউল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালে। দুধ বিক্রির পাশাপাশি দইয়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। দইয়ের ব্যবসায় লাভ বেশি হওয়ায় প্রতিদিনের পরিবারের খরচ মিটিয়ে বাকি অর্থ দিয়ে নেমে পড়েন সমাজসেবায়। প্রতিদিন দই মাথায় নিয়ে সাইকেলে করে বিক্রি করেছেন গ্রামে-গঞ্জে। তার তৈরি দইয়ের নামডাকও দেশজুড়ে। আর দই বিক্রির টাকা থেকে কিনতেন দু-একটি বই অথবা পত্রপত্রিকা। আর এভাবেই ১৯৬৯ সাল থেকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’।
শুরুর দিকে অভাবগ্রস্ত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিতেন। বর্ষ শেষে আবার ফেরত নিয়ে আসতেন। পরবর্তীতে স্থানীয় হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় পাঠ্যবই, পবিত্র কোরআন মাজিদ ও এতিমদের পোশাক, শীতবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রাখেন। পবিত্র ঈদে দুস্থদের মধ্যে কাপড় বিতরণ করেন। এ ছাড়া গ্রামের বিভিন্ন ছিন্নমূল মানুষকে টিনের ঘরও তৈরি করে দেন। এতিমখানায় পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির খাসি কিনে দেন। এভাবেই তিনি সমাজসেবা করে আসছেন।
আপাদমস্তক সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জিয়াউল হকের পাঠাগারে ২০ হাজারের বেশি বই আছে। দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তি ও সংস্থা তাকে বই ও সেলফ দিয়ে সহায়তা করেছেন। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী জিয়াউল হক তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননাও পেয়েছেন।
এ দিকে, জিয়াউল হকের একুশে পদক প্রাপ্তিতে আনন্দে ভাসছে ভোলাহাটসহ পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। তাকে অনেকেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন।