এক সময়ে আমাদের সমাজে ‘প্রতিবেশী’ শব্দটি ছিল আত্মীয়তারই এক সম্প্রসারিত রূপ। ঘরের পাশের মানুষটির সঙ্গে ছিল এক ধরনের অদৃশ্য আত্মীয়তা, যার ভিত্তি ছিল ভালোবাসা, সহানুভূতি, ও পারস্পরিক সহযোগিতা। কিন্তু আধুনিক নগরায়নের ঢেউয়ে গড়ে ওঠা অ্যাপার্টমেন্ট সংস্কৃতিতে আজ সেই আন্তরিক সম্পর্ক হারিয়ে যেতে বসেছে।
ঢাকার মতো মহানগরীতে জমির সংকট, নিরাপত্তার প্রশ্ন, এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার হাতছানিতে মানুষ দলে দলে বসতবাড়ি ছেড়ে অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু এই স্থানান্তর ঘটছে কেবল স্থানিক নয়, মানসিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিক থেকেও। এখনকার ফ্ল্যাটবাসীরা বেশিরভাগই জানেন না তাদের পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকেন, কী করেন, কিংবা কোনো বিপদে আছেন কি না।
অ্যাপার্টমেন্টে বাস করা মানুষদের জীবনে নিরাপত্তা ও নিয়মের কাঠামো অনেক শক্তিশালী। গেটের সামনে প্রহরী, সিসিটিভি ক্যামেরা, রক্ষিত প্রবেশপথ—সবই আছে। কিন্তু নেই একটি হাসিমাখা মুখ, নেই পাশে দাঁড়ানোর একজন প্রতিবেশী। কেউ অসুস্থ হলে খবর জানার কেউ নেই, কেউ নতুন বাসিন্দা হলে তাকে পরিচয় করানোর কোনো রেওয়াজ নেই। কেউ মারা গেলে অনেকে জানতেই পারেন না।
এই বিচ্ছিন্নতার বড় কারণ হলো আত্মকেন্দ্রিক জীবনধারা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার চর্চা। এখন মানুষ ‘আমার জীবন, আমার ঘর’ এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই আটকে পড়ছে। প্রযুক্তির প্রসার এবং ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের জালও বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে আরও শুষ্ক করে তুলছে।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলাকে ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকেও উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—প্রতিটি ধর্মেই প্রতিবেশীর অধিকার এবং প্রতি মানবিক দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
একটি বিপদে পড়া পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর প্রথম সুযোগ পাওয়ার কথা প্রতিবেশীর, কিন্তু এখন সে জায়গাটি প্রায় খালি।
কেন এই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে?
ব্যস্ত জীবনযাপন: সকালে অফিস, সন্ধ্যায় ক্লান্ত ফেরা, রাতে একঘরে অবসাদ—এই চক্রেই আটকে মানুষ।
নিরাপত্তাজনিত দূরত্ব: অজানা কাউকে বিশ্বাস করতে না পারার কারণে দূরত্ব গড়ে ওঠে।
কমিউনিটি চেতনার অভাব: অনেক অ্যাপার্টমেন্টেই মিটিং হয় শুধুমাত্র মেইনটেন্যান্সের বিষয় নিয়ে, মানুষের সম্পর্ক নিয়ে নয়।
এককেন্দ্রিকতা ও ব্যক্তিগত গণ্ডিতে সীমাবদ্ধতা: কারো জীবনে কী ঘটছে, সেটা জানার আগ্রহ বা সময়ও অনেকের থাকে না।
তবে সব কিছু হারিয়ে গেছে, এমন ভাবার সুযোগ নেই। এখনও অনেক অ্যাপার্টমেন্টে কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন, যারা প্রতিবেশীদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান, উৎসব-অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ করেন। কমিউনিটি ভিত্তিক ‘গেট-টুগেদার’, শিশুদের খেলাধুলার আয়োজন, ছাদে শীতকালীন বনভোজন—এমন ছোট ছোট উদ্যোগ অনেক বড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
তরুণদেরকেই এই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি বাস্তব জীবনে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীতা তৈরি করতে হবে, যেখানে একজন আরেকজনের খোঁজ নেবে, বিপদে এগিয়ে আসবে, এবং একে অপরের প্রয়োজনে ছায়ার মতো পাশে থাকবে।
প্রতিবেশী সম্পর্ক একটি সমাজের মৌলিক ভিত্তি। অ্যাপার্টমেন্টের দেয়ালগুলো যতই পুরু হোক না কেন, মানুষকে আলাদা করে রাখা উচিত নয়। সম্পর্কের উষ্ণতা, পারস্পরিক সহানুভূতি আর মানবিক সংযোগ—এই গুণগুলো ছাড়া উন্নত নাগরিক জীবন কখনোই পূর্ণতা পায় না। এখনই সময়, আমরা সবাই মিলে একটিবার ভাবি—আমি কি আমার পাশের দরজার মানুষটিকে চিনি?