ইকোনোমিক ডেস্ক: প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে ডলারের বাজারে অস্থিরতা। দেশে ৪১০০ কোটি ডলারের বেশি রিজার্ভ রয়েছে। এরপরও এ বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তারপরও দেশে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার।
মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা সামলাতে অল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েকবার ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সবশেষ এক ধাক্কায় ৮০ পয়সা বাড়িয়ে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিন্তু খোলাবাজারে এই দামে ডলার মিলছে না। গতকাল মঙ্গলবার (১৭ মে) এক ডলার কিনতে ১০০ টাকার বেশি গুণতে হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এ মুহূর্তে ৪,১০০ কোটি ডলারের বেশি রিজার্ভ রয়েছে। তা সত্ত্বেও এ বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে। নেপথ্যে আমদানি ব্যয় ব্যাপক হারে বৃদ্ধিকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ‘রিজার্ভকে আমরা স্বস্তিদায়ক মনে করছি। তবে এ মুহূর্তে কথাটা সঠিক নয়। আমাদের আমদানি ব্যয় বহুলাংশে বেড়েছে। গত নয় মাসে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৭ শতাংশ। ফলে বিদ্যমান রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অথচ এই রিজার্ভ দিয়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল।’
অর্থনীতিবিদ মোয়াজ্জেম বলেন, এখন ৪১০০ কোটি ডলার রিজার্ভ রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা ন্যূনতম। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে একে চ্যালেঞ্জ বলা যায়।
তেল, ডালসহ খাদ্যদ্রব্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। একইসঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ডলারের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, দেশে ডলারের দাম বাড়ায় খাদ্যদ্রব্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন তারা। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে শীর্ষপর্যায়ের আমদানিকারক আবুল বাশার চৌধুরী জানান, ডলারের বাজারে নজরদারির অভাবে অস্বস্তিতে রয়েছেন তারা।
তিনি উল্লেখ করেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো ডলারের দাম নেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তার বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঠিক করে দেয়া ডলারের দাম মানছে না বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ৯৫ বা ৯৬ টাকা করে নিচ্ছে এগুলো। যা কাম্য নয়।
আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, ‘দামে এতটা পার্থক্য করা ঠিক নয়। ডলারের দাম বাড়ায় আগে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি করতাম, এখন সেটার অর্ধেকের বেশি করতে পারছি না আমরা।’
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবু গতকাল খোলাবাজারে ডলারের দাম উঠেছে ১০০ টাকার বেশি। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যার যার মতো বাড়তি দাম নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওয়ান ব্যাংকের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার পারুল বিশ্বাস বলেন, বাজারে ডলারের ঘাটতি থাকায় ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়েছে। আসলে ব্যাংকগুলোর হাতে আমদানির এলসি খোলার মতো যথেষ্ট ডলার আছে কিনা- সে প্রশ্ন রয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোকে ডলার কিনতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘রেমিটেন্স বা একচেঞ্জ হাউজ এবং বিদেশি ব্যাংক অথবা স্থানীয়দের কাছ এই ডলার কিনতে হচ্ছে আমাদের। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত দাম দিয়ে মার্কেট থেকে তা কিনতে পারছি না। এতে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’
পারুল বিশ্বাস বলেন, ‘ইমপোর্টের পেমেন্ট হয়ে যাচ্ছে ৯৫ টাকা বা ৯৬ টাকা। কারণ, আমাদের কিনতে হচ্ছে ৯৩ টাকায়। সেটা ৮৭ টাকা ৫০ পয়সায় দেয়া সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, খাদ্যদ্রব্য ছাড়া বিলাসবহুল সামগ্রী আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়িয়ে তা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, ‘নানা পদক্ষেপ নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, আমাদের রেমিটেন্স বাড়ছে। জুলাইয়ে কোরবানির ঈদের সময় তা আরও বাড়বে। এছাড়া রপ্তানিও বেড়েছে। ফলে আশা করছি, কিছু দিনের মধ্যেই ডলারের বাজার ভারসাম্যের মধ্যে আসবে।’
এ মুহূর্তে রেমিটেন্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের তাতে সন্দেহ রয়েছে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সম্প্রতি রপ্তানি আয় বেড়েছে। তবে এক মাসে ৮৩০০ কোটি ডলার আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে রপ্তানি আয় হচ্ছে ৪৫০০ কোটি ডলার। ফলে আমদানি ব্যয় অনেক বেশি থাকছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ডলারের দাম বাড়তে থাকলে যারা রেমিটেন্স পাঠান, তাদের মধ্যে খোলাবাজারে দাম বেশি পেতে হুন্ডির মাধ্যমে বা অন্য উপায়ে দেশে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বাড়বে। এই পরিস্থিতি ডলারের বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অর্থনীতিবিদ ও আমদানিকারকরা অবশ্য মনে করেন, ডলারের অস্থির বাজার সামলানোর এখনও সময় রয়েছে। সেজন্য কর্তৃপক্ষের আরও সতর্ক থাকা ও নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।