বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ভাদুঘরের শান্তিনগরের মাঠে তখন নীরবতা। এলাকার সবাই খোঁজ নিচ্ছিলেন ছোট দুই ভাই-বোনের। দুপুরে তারা বের হয়েছিল শাপলা তুলতে, অথচ আর ফিরে আসেনি। পরদিন সকালে বাড়ির পাশের ডোবায় ভেসে ওঠে হোসাইন (১১) ও জিন্নাতের (৮) নিথর দেহ। এ ঘটনা ঘটেছে ৪ জুলাই। কোথাও শাপলা তোলার উচ্ছ্বাসে, কোথাও ঈদের ছুটির আনন্দে বাড়ি গিয়ে বা ভিন্ন কোনো কারণে একটা অসতর্ক মুহূর্ত আর একটা অরক্ষিত জলাশয় কেড়ে নিচ্ছে শিশুর জীবন।
২০২৪ সালে শেষ করা ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন দেশে ৫১ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে। এর ৭৫ শতাংশের বেশি শিশু। এই মৃত্যুগুলো কেবল সংখ্যা নয়, প্রতিটি ঘটনাই একেকটি পরিবারের জীবনের শোকগাথা। এই পরিস্থিতিতে আজ ২৫ জুলাই পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’।
২০২৩ সালের মে মাসে জরিপের কাজ শুরু হয়ে তা শেষ হয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সরকার এটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে এই জরিপের ক্ষেত্রে। ১ লাখ ১১ হাজার পরিবারের উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এই গবেষণার কাজ করে। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিআইপিআরবির পরিচালক সেলিম মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর যে হার, সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা। পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে কিছু কাজ চলছে বটে; কিন্তু এর পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত করা উচিত।
২০২৪ সালের করা জরিপে বাংলাদেশে আঘাতজনিত মৃত্যু এবং আঘাতজনিত আহতদের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৬০ জনের আঘাতজনিত মৃত্যু হয়। আঘাতজনিত মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা এবং পানিতে ডোবা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১৫ শতাংশ, আত্মহত্যা ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ, আর পানিতে ডোবা ১১ শতাংশ।
জরিপের ফল অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে প্রায় ১৮ হাজার ৬৬৫ জন মানুষ। তার মধ্যে ১৪ হাজার ২৬৯ জনই শিশু—অর্থাৎ ৭৫ শতাংশের বেশি। শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ১ থেকে ৪ বছর বয়সীরা।
গবেষণায় উঠে এসেছে, সব ডুবে মৃত্যুর ৭০ শতাংশই ঘটছে বাড়ির পাশে থাকা পুকুরে।
নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি এখন ডুবে মৃত্যু রোধে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। ১-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র এবং ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য সাঁতার শেখানো হয়। এখন ১৬ জেলার ৪৫টি উপজেলায় এ প্রকল্প চলছে। শিশু একাডেমির এই প্রকল্পের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যেসব এলাকায় এই প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে, সেখানে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে।
দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, এখন ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে যে ধরনের কাজ হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রের চেয়ে সমাজভিত্তিক দিবাযত্ন করা অনেক বেশি কার্যকর হবে।