সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক, আজনিউজ২৪: বিভিন্ন সময়ে পেশাগত জীবনের নানা স্মৃতির কথা মনে পড়ে। প্রাসঙ্গিক কারণে আজ এরকম অসংখ্য গল্পের একটি বলতে চাই। বিষয়টা অনেকটা এরকম “রাত ১ টায় ইউএনও সাহেবকে এক গেরস্থ ফোন করে বাসায় সাপ ঢুকেছে মর্মে উদ্ধারের আকুতি জানান”। পরে ওসি সাহেবকে সাথে নিয়ে ইউএনও সাহেব সে রাতে গেরস্থকে সাপ থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন (আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা)। অথচ এটা হয়তো সেই অর্থে ইউএনও সাহেবের কাজই না।
এবার মূল গল্পে আসা যাক। একদিন বিকাল বেলায় অফিসে বসে কাজ করছি। কাজের চাপে দুপুরের ভাতও খেতে পারিনি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক রুমে এসে কী মনে করে আমার হাতে একটা দরখাস্ত ধরিয়ে দিয়ে বললেন; স্যার একটু দেখবেন? আমি তাকে বললাম হ্যাঁ দেখবো। হাতের কাজটা শেষ করি? তিনি সায় দিলেন। অফিস সহায়ককে বললাম উনাকে চা-বিস্কুট দাও। উনাকে চা-বিস্কুট খেতে দেওয়ায় উনি খুব অবাক হলেন। হয়তো এরকম সমাদার তিনি সাম্প্রতিক সময়ে পাননি।
যাহোক হাতের কাজ শেষ করে উনার দরখাস্তটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখলাম উনি যা চেয়েছেন “অ্যালোকেশন অব বিজনেস” অনুযায়ী এটা আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ না। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম আপনি অমুক মন্ত্রণালয়ে যান, এটা তাদের কাজ। তিনি প্রতিউত্তরে বললেন স্যার আমারে মাফ করে দেন। আমি আর কোথাও যেতে পারবো না। এ কাজ আপনিই করে দিবেন, কেমনে করে দিবেন জানি না। তাঁর চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। কী মুশকীল! পরে শুনলাম তিনি এর আগে গত ২ মাসে এ সংক্রান্ত কয়েকটা মন্ত্রণালয়ে ঘুরেছেন, কিন্তু কাউকে তিনি তাঁর প্রয়োজনের কথা বুঝাতে পারেননি।
যাহোক সব বিষয়েরই একটা অল্টারনেটিভ সমাধান থাকে। আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ না হওয়া সত্বেও আমিও সে পথ বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে বললাম আপনি দরখাস্তটা সচিব মহোদয়ের দপ্তরে রেখে চলে যান, দেখি কী করা যায়। সি কিউ কে মোস্তাক স্যার (পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র সচিব) সহ অনেক সচিব স্যারকে বলতে শুনেছি ” মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর কর্মকর্তা হলেন শাখা কর্মকর্তা। শাখা কর্মকর্তা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারেন। আমি তখন সে বলে বলিষ্ঠ। হা হা হা।
আমি সে সময়ে মন্ত্রণালয়ের পলিসি উইং-এ কাজ করতাম। পলিসি উইং মানে সারাদিন পড়াশোনা করা, আর বিভিন্ন পলিসি ইস্যুতে ইনপুট দেওয়া। এ কাজ সত্যিই কষ্টদায়ক। প্রায় কেউই করতে চান না। তবে এটা কাজ করার এমন একটা ক্ষেত্র যেখান থেকে আপনি বুদ্ধি খাটিয়ে এক কলমের খোঁচায় অনেকের কোটি টাকার উপকার (সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে) করতে পারবেন । হুম, একটুও বাড়িয়ে বলছি না!
যাহোক, সে যাত্রায় উর্দ্ধতন স্যারদের সাথে কথা বলে মাননীয় মন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে সে ব্যাক্তির দরখাস্ত খানা শোল্ডারিং করে প্রযোজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলাম। সে যাত্রায় সে ব্যাক্তি সেই যে চলে গেছেন আর যোগাযোগ করেননি। হঠাৎ একদিন প্রযোজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হলো, আমি ইতোপূর্বে যে বিষয়টি (সেই ব্যাক্তির দরখাস্ত) আমার মন্ত্রণালয় থেকে অগ্রায়ণ করেছিলাম তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য এ সংক্রান্ত জাতীয় পরিষদে এজেন্ডাভুক্ত হয়েছে। পরবর্তীতে সেই ভদ্রলোকের আর্জি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাশ করে দিলেন। সে ব্যাক্তির (প্রতিষ্ঠানের) কোটি টাকার উপকার হয়ে গেলো! কী, সিনেমার মতো শোনায় না?
পরের দিন সে ব্যাক্তি আমার কক্ষে হাজির হয়ে আনন্দে কেঁদে দিয়ে বললেন আমি কী চাই? আমি বললাম একদম কিছু না। এটা আমার দায়িত্ব। দোয়া করবেন। পরের সপ্তাহে কাকতালীয়ভাবে দেখলাম প্রথম আলোর প্রথম পাতায় তাঁর উদীয়মান উদ্যোগ নিয়ে বিশাল খবর। আমি চমকে গেলাম। বাহ, দারুন তো।
এরপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমি বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরলে তিনি আমাকে ফোন করেন। এবার অন্য আবদার। তিনি ভীষণ অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য জরুরী বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন। ভিসার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তিনি যে দেশে যেতে চান তারা এখন খুব একটা ভিসা দিচ্ছে না। আমি সেই ইউএনও’র মতো চিন্তায় পড়ে গেলাম কীভাবে তাঁকে নিশি রাতের সাপ থেকে উদ্ধার করা যায়। যাহোক আমার ভাইদের যখনই আমি কাউকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করি তাঁরা সাধ্যের সবটুকু দিয়ে হাত বাড়ায়। এ যাত্রায় ছোট ভাইয়ের (সিভিল সার্ভেন্ট) সহায়তায় ভদ্রলোক গতকাল ভিসা পেয়েছেন। মানুষকে সাহায্য করার মতো আনন্দ আসলে আর কোথাও নাই। জনগণের কর্মচারী হিসেবে জনগণের সেবায় আসতে পারলে, কার না ভালো লাগে। মহান সৃষ্টিকর্তা সবসময়ই সে সুযোগ প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার দিক। আমিন।
পেশাগত জীবনের নানা স্মৃতির কথা মনে পড়ে : মো : সাঈমুর রশীদ খান
বিচিত্রতা
0 Views