নদী ও জলাশয়ের সুরক্ষায় শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও দখল-দূষণের মাধ্যমে পরিবেশকে যখন হুমকির মুখে ফেলা দেওয়া বন্ধ হয় না, তার চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী হতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই যখন আইন লঙ্ঘন করে নদী, হাওর, বিল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে, তখন আইনের বাস্তবায়নটা কে করবে? চলনবিলের পর এবার সুনামগঞ্জের দেখার হাওরকে হুমকির মুখে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অথচ চলনবিল ও দেখার হাওর—দুটিই কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার। ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করা হলে যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়।
শিক্ষাবিদদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার মান ও উচ্চশিক্ষার সুযোগের চেয়ে এখানে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং জমি অধিগ্রহণ থেকে অবকাঠামো নির্মাণের অর্থায়নই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়েছে। সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও এই প্রবণতার বাইরে নয়। ২০২০ সালের ২৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাস হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য ১২৫ একরের যে জায়গাটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে, সেই জায়গা বছরের সাত মাস পানির নিচে ডুবে থাকে। আর শুষ্ক মৌসুমে ধানের চাষ হয়। ফলে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পুরো জায়গাটি ভরাট করে ফেলতে হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব হবে বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী।
হাওর ধ্বংস করে অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ করলে তার প্রভাব যে কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে, সিলেট অঞ্চলের সাম্প্রতিক কালের বন্যাগুলো তার একেবারে চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত। গত চার দশকে হাওরের আয়তন কমেছে প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার। ফলে এমনিতেই বর্ষা মৌসুমে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় থেকে আসা পানির তোড় সামলাতে পারছে না হাওরের মতো প্রাকৃতিক সুরক্ষাবেষ্টনী।
পরিবেশবিদেরা উদ্বেগ জানিয়েছেন যে দেখার হাওরে বিশ্ববিদ্যালয় হলে নাইন্দা নদীর পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে সেখানে যে সড়ক ও জনপদ গড়ে উঠবে, তাতে দীর্ঘমেয়াদে হাওরের কৃষি, মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের স্থায়ী ক্ষতি করবে। পরিবেশের দিক থেকে এ রকম একটা নাজুক স্থানে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কীভাবে অনাপত্তিপত্র দেয়? সবচেয়ে পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সরকার যখন পানি আইনের ২০১৩-এর আওতায় হাওর প্রতিবেশ সুরক্ষা আদেশের খসড়া চূড়ান্ত করছে, সে সময়ই একটি হাওরকে হুমকির মুখে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে। পরিবেশ প্রশ্নে সরকারের নীতিগত অবস্থান তাহলে কী? পরিবেশ সুরক্ষায় আইন নয়, আইনের বাস্তবায়নই মূল বাধা।
পরিবেশগত সংবেদনশীল স্থান চলনবিলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়া এলাকায় চলনবিলের শেষ অংশে এসে মিলিত হয়েছে শতাধিক খাল, বিল, বড়াল নদসহ অর্ধশতাধিক নদীর পানি। এসব উৎস থেকে আসা পানির সম্মিলিত প্রবাহ গিয়ে মিলিত হয় যমুনা নদীর সঙ্গে। এই পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করতে চায়। সেখানে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হলে একদিকে চলনবিলের জলজ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা ও বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে তুলবে।
এটা ঠিক, বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় দরকার, কিন্তু কোনোভাবেই বিল, হাওর ভরাট করে তা করা যাবে না। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারকে অবশ্যই নীতিগত অবস্থান সুস্পষ্ট করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান আইন লঙ্ঘনের বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে না।