১২টি মাসের মধ্যে রমজান একটি অন্যতম সম্মানিত মাস। ইসলামের ৫টি রোকনের মধ্যে রমজান মাসের রোজা একটি রোকন। এ মাসটি অন্যান্য মাস হতে বিশেষ গৌরবের অধিকারী। মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশেষ দিনগুলো আল্লাহ পাক রাব্বুল আল-আমীনের এক একটি নেয়ামত। ঈমান আমলকে আরও বেশি বিশ্বাস স্থাপন করাটাই একজন খাঁটি মুসলমানের মূল লক্ষ্য। তাই আল্লাহর তরফ থেকে পবিত্র মাহে রমজান মাস মুসলমানদের জন্য একটি বিশেষ রহমত। মহান আল্লাহতায়ালা এ মাসকে বিশেষভাবে সম্মানিত, মহিমাত ও গৌরবানিত করেছেন। রমজান আরবী শব্দ রময ধাতু হতে উদ্ভুত। যার অর্থ হচ্ছে- জ্বালানো, পোড়ানো। এ মাস মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ধ্বংস করে সুপ্রবৃত্তিকে বিকাশ করে।
অন্যদিকে, রোজাকে আরবী ভাষায় সিয়াম বলা হয়। সিয়াম-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে দহন, জ্বলন। সিয়ামের আরেক অর্থ কোন কিছু থেকে বিরত থাকা বা বেঁচে থাকা বা পরিত্যাগ করা। শরীয়তের পরিভাষায় খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম সওম। সুবেহ সাদেক হওয়ার পূর্ব থেকে শুরু করে সুর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে একাধারে এভাবে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকলেই তা রোজা হিসেবে পরিগণিত হবে। সুর্যাস্তের এক মিনিটের আগেও রোজাদার যদি কোন কিছু খেয়ে ফেলে, পান করে কিংবা সহবাস করে, তবে রোজা হবে না। এ রমজান আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত নেয়ামত, রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আসে আমাদের মাঝে। কোরআন এবং হাদীসে এই রমজান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। প্রতিটি সক্ষম মুসলমান নর-নারীর ওপর এই এক মাসে রোজা বা সিয়াম সাধনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, একইসঙ্গে এর অসংখ্য ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে কোরআন ও হাদীসে।
এক হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, রোজাদারের পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ পাক প্রদান করবেন। অন্য এক হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে রোজা মুমিনের জন্য ঢাল স্বরূপ। এই রমজান মাস আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার জন্য রহমত, বরকত ও মাগফেরাত হিসেবে অভির্ভূত হয়। হাদীস শরীফে (সহীহ বোখারী, সহীহ তিরমিযি, ইমাম হাম্বলী, ইবনে কাসীর প্রভৃতি) বর্ণিত রয়েছে, বিশেষ করে সাহাবী ক্কাআব বিন ঊজাইর রাজি আল্লাহু তাআলা আনহু (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার জুমার খুৎবা দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (সা.) যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখেন, তখন বলেন আমীন, দ্বিতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখেন, তখন বলেন আমীন, একইভাবে তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও বলেন, আমীন।
নামায শেষে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে তিনবার অস্বাভাবিকভাবে আমীন বলার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি, তখন জিব্রাইল আলাইহিসসাল্লাম (আ.) ওহী নিয়ে আসেন এবং বলেন, ধ্বংস হয়ে যাক, সেই ব্যক্তি, যে রমজান মাসের রোজা পেল অথচ গুনাহ্ মাফ করাতে পারল না, এর জবাবে আমি বললাম আমীন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিব্রাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হয়ে যাক, সে যার সামনে আমার নাম নেওয়া হলো অথচ দরুদ শরীফ পড়ল না, জবাবে বলেছি আমীন। তৃতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখলাম, জিব্রাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হয়ে যাক, সে যে বা যারা তার মা-বাবা কিংবা উভয়ের যে কোনো একজনকে পেল অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাত হাসিল করতে পারল না, জবাবে বলেছি আমীন।
[[ পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত নেয়ামত, রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আসে আমাদের মাঝে। কোরআন এবং হাদীসে এই রমজান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। রোজাদারের পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ পাক প্রদান করবেন। অন্য এক হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে রোজা মুমিনের জন্য ঢাল স্বরূপ। দিনে-রাতে আল্লাহ পাক তার রহমতের দরজা খুলে বান্দার নিকটবর্তী হয়ে গুণাহগার বান্দাদের মাফ করে দিচ্ছেন এবং তা চলতে থাকবে অনবরত একেবারে ঈদের রাত পর্যন্ত।এই রমজান মাস আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার জন্য রহমত, বরকত ও মাগফেরাত হিসেবে অভির্ভূত হয়।]]
এই হাদীসের শুরুতেই বলা হয়েছে রমজান শরীফের কথা। রমজান মাস যখন শুরু হয়, তখন আল্লাহ পাক এই মাসের প্রথম রাতেই দশ লক্ষ বান্দাকে মাফ করে দেন, যাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে রয়েছে, এমন সব গুণাহগারদের মাফ করে দেন, লাইলাতুল কদরের রাতে অসংখ্য, অগণিত বান্দাকে মাফ করে দেন, আর মাসের ২৯ তারিখ রাতে সারা মাসের যত মাফ করা হয়েছে তার দ্বিগুণ, আর ঈদের রাতে আরো দ্বিগুণ সংখ্যক বান্দার গূনাহ মাফ করে দেন বলে হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। তবে কবীরা গুণাহের জন্য তওবা করে মাফ চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা রাজি আল্লাহু তাআলা আনহু (রা.) থেকে বর্ণিত, যে বা যারা পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশ্বাসের সঙ্গে রমজান মাসে দিনের বেলা যাবতীয় পানাহার থেকে বিরত থাকবে অর্থাৎ রোজা রাখবে ও রাতে পরিপূর্ণ ঈমানের সঙ্গে নামায পড়বে, এবাদত-বন্দেগী করবে, লাইলাতুল কদরের রাতে জেগে এবাদত করবে, আল্লাহ পাক সে বান্দার পেছনের সব গূনাহ মাফ করে দেবেন। সহীহ বোখারী ও মুসলিমসহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে এই হাদীসের সত্যতা নির্ভুলভাবে পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরাইরা রাজি আল্লাহু তাআলা আনহু (রা.) আরো বর্ণনা করেছেন, রমজান মাসে বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তালাবদ্ধ করে রাখা হয় শয়তান ও জিনদের। রমজানের প্রতিটি দিন ও রাতে অগণিত বান্দাকে আল্লাহ পাক দোজখের আজাব থেকে মাফ করে দিতে থাকেন।
এই রমজান মাসে কেউ রোজাদারকে এক ফোঁটা দুধ, পানি বা খেজুর অথবা যেকোনো খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ইফতার করালে আল্লাহ পাক তাকে দোজখের আযাব থেকে মাফ করে দেবেন, আল্লাহ পাক তাকে রোজাদারের সমান সওয়াব দেবেন। তবে রোজাদারের সওয়াব থেকে সামান্যও কমানো হবে না। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (সা.) বলেছেন, মাগফেরাতের দোয়া রমজানের শেষ রাতে কবুল হয়েছে, সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলে ওই রাত লাইলাতুল কদরের রাত কিনা জানতে চাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, না, কারণ আল্লাহ পাক তার বান্দার মজুরি রমজান পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে দেন। বলাই বাহুল্য হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পূর্ণ নির্মল ও নেক শ্রেষ্ঠ নবী হওয়া সত্ত্বেও রমজানে আল্লাহর দরবারে এতো এবাদত বন্দেগী করেছেন, আর আমরা তো তার উম্মত, আমাদেরও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বেশি বেশি এবাদত-বন্দেগী করা উচিৎ।
রমজান মাসের প্রতিটি সময়, প্রতিটি ক্ষণ অত্যন্ত মূল্যবান। অন্য যে কোনো মাসে যেমন নির্দিষ্ট সময় বা শেষ রাতে বা তাহাজ্জুদের সময় বান্দার দোয়া কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু রমজান মাসে প্রতিটি সময় বান্দার দোয়া কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। দিনে-রাতে আল্লাহ পাক তার রহমতের দরজা খুলে বান্দার নিকটবর্তী হয়ে গূনাহগার বান্দাদের মাফ করে দিচ্ছেন এবং তা চলতে থাকবে অনবরত একেবারে ঈদের রাত পর্যন্ত।
এই রমজান মাসে শেষ দশ দিনের মধ্যে যেকোনো বেজোড় রাত লাইলাতুল কদরের রাত বলে কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যা হাজার মাসের এবাদত-বন্দেগীর চাইতে উত্তম রাত। তাই আমাদের সবার কদরের রাতসহ রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণ ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানো উচিৎ। রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার এ সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মহান আল্লাহ রমজান মাসকে বহুবিধ ফজিলতের জন্য নির্বাচিত করেছেন। অনেক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে তিনি রমজানকে বিশেষ স্বাতন্ত্র দান করেছেন। যে কারণে রমজান মাস অন্যান্য মাসের মাঝে অনন্য। বিবিধ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার যিনি রমজানকে শ্রেষ্ঠ মাস বানিয়েছেন এবং সে সময় ভাল কাজের প্রতিদান বাড়িয়ে দিয়েছেন। মেঘমালার ন্যায় দিনগুলি অতিবাহিত হচ্ছে। বছর খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে। আর আমরা জীবন চলার পথে অলস সময় কাটাচ্ছি।
আমাদের মধ্যে কম সংখ্যক লোক এমন আছেন যারা বাস্তবতা ও পরিণতি নিয়ে চিন্তা করছে অথবা তার থেকে উপদেশ গ্রহণ করছে। মানুষের জীবনের কম বয়সে এবং অল্প সময়ের মধ্যে আল্লাহ তাআলা তার জন্য ভাল কাজের মৌসুম রেখেছেন। তার জন্য স্থান এবং কালের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে কাল ও স্থানের মাধ্যমে সে তার ত্র“টি বিচ্যুতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। সে সব বিশেষ মৌসুমের মধ্য থেকে অন্যতম একটি মৌসুম হল পবিত্র রমজান মাস। সিয়াম পালনকারীর দুটি খুশি, প্রথম খুশি যখন সে ইফতার করে, আর এক খুশি যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশক আম্বরের চেয়ে অধিক প্রিয়। (বুখারী মুসলিম)
এ বছর রমজান মাস কি আল্লাহ তাআলার দিকে ফিরে আসার মৌসুম হবে এবং নিজের হিসাব নিকাশের সুযোগ করে দেবে, আর আল্লাহর সামনে নিজের গোনাহের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ করে দেবে? সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য সত্যিকারভাবে ইসলামী জীবন যাপন করার সুযোগ এনে দেবে কি এ মহান মাস? এ মাসকে দাওয়াত দানকারীগণ তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে দৃষ্টি-ভঙ্গি পাল্টিয়ে নুতন করে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এ কথা চিন্তা করে যে, তারা সর্বোত্তম দাওয়াতের দায়িত্ব পালনকারী। এবং তারা অতি উত্তম উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন। তারা নিজের সত্তার চিন্তা এবং তার জন্য ঘোরাফেরা করা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু আল্লাহর নিকট যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী মনে করে কাজ করবে। এ মাসটি প্রত্যেক মুসলমান তার মুসলমান ভাইকে সাহায্য করার মাস হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। হোক না সে অত্যাচারী অথবা অত্যাচারিত। অত্যাচারীর অত্যাচার প্রতিরোধ করে তাকে সাহায্য করবে।
অত্যাচারিতকে সাহয্য করবে তার সহযোগিতার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে মুসলমান সমাজে সর্বত্র ভাল পরিবেশ তৈরী হবে। এ মাসটি ধনী এবং আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপনকারীদের জন্যও বিরাট সুযোগ। তাদের কাজ-কর্ম এবং অনুভূতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য তারা যেন দরিদ্রদের প্রয়োজন ও ব্যথা অনুভব করতে পারে। নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। আল্লাহ যে পথে ব্যয় করতে সম্পদ দিয়েছেন সে পথে তারা সম্পদ ব্যয় করতে পারে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যারা ক্ষুধার্ত আছে তাদের বাঁচাতে তারা যেন এগিয়ে আসতে পারে। তারা যদি তাদের ক্ষুধার্তদেরকে না খাওয়ায়, বস্ত্রহীনদেরকে বস্ত্র না দেয় আর দুর্বলদেরকে সাহায্য না করে মনে করতে হবে তাদের ঈমান বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে। তাই মুসলিম সম্প্রদায়কে এই বিশেষ নেয়ামতের মাসে বেশী করে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গী স্থাপন করে আল্লাহর তায়ালার সান্নিধ্য লাভ করাটাই ঈমান ও আমলের একটি প্রধান উদ্ধেশ্য।
বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা হউক এই পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষ্যে। রমজান আমাদের নিজেদের জন্য এমন একটি পদ্ধতি অবলম্বনের সুযোগ এনে দেয় যার মাধ্যমে ইসলামী ভাবধারায় অভ্যস্ত হতে পারি। সকলের হাত, পা, চোখ, কান, জিহবা, মুসলমান হয়ে যাবে। যখনই এ সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ নড়া-চড়া করবে তার সৃস্টিকর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী করবে। মা-বাবা, ভাই-বোনআল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুক যে, একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে রমযান মাসের ইবাদতে মশগুল হতে পারি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে আরও বেশি ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হউক; এই আমাদের অঙ্গীকার পবিত্র মাহে রমজানকে ঘিরে। আমীন।
সাংবাদিক, গবেষক, লেখক