সেন্ট্রাল ডেস্ক: আগামী জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করতে পারেন বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। এ ছাড়া আগামী বছরের মার্চে বা জুনে পদ্ম সেতুতে ট্রেন চলবে বলে জানান তিনি।
রোববার নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান রেলমন্ত্রী।
এরআগে সেতু বিভাগ জানিয়েছে, আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়েই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। এমনটিই আভাস দিয়েছে সেতু বিভাগ। সেতু বিভাগের একটি বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে, এদিনই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামও একই রকম আভাস দিলেন। গতকাল তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমাদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আগামী মাসের মধ্যে অর্থাৎ জুনের মধ্যেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর কাজ শতভাগ সম্পন্ন করার। আমরা সে লক্ষ্যে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি, আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন করতে পারব। মূল সেতুর কার্পেটিং ও পিচ ঢালাইয়ের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। এখন দুপাশের সংযোগ সড়কের পিচ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। বিগত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে এ কাজের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে, তবে যেহেতু টানা বৃষ্টি হচ্ছে না, তাই প্রতিদিনের কাজগুলো আমরা সম্পন্ন করতে পারছি। সুতরাং আমরা খুবই আশাবাদী জুনের মধ্যেই মূল সেতুর শতভাগ কাজ সম্পন্ন করতে পারব।
এদিকে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের জন্য জুনের শেষদিকে তিনটি সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সময় চাওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ২৫ জুনকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঠিক করতে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেন। এ বিষয়ে সেতু বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের জন্য জুনের শেষদিকে তিনটি দিন ঠিক করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম দিন ধার্য করা হয় ২৩ জুন। এদিনটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন হওয়ায় প্রথম পছন্দে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেদিন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর নানা অনুষ্ঠান থাকায় প্রধানমন্ত্রী সেব অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকবেন। শেষ পর্যন্ত ২৩ জুন থেকে সরে যাওয়া হয়। এরপর পছন্দের দিন ছিল ২৮ জুন। কিন্তু ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে, জাতীয় সংসদে। এজন্য বাজেট পাসের আগে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য অনেক মন্ত্রীর ব্যস্ততা থাকবে, তাই এদিনটি থেকেও সরে যাওয়া হয়। এই দুদিনের মধ্যে থাকে ২৫ জুন। তুলনামূলকভাবে এদিন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কম থাকায় ২৫ জুনকেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের জন্য ঠিক করা হয়েছে। সেতু বিভাগ সেদিনকে সামনে রেখেই সব প্রস্তুতি নিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সময় দিলে হয়তো সেদিনই উদ্বোধন হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর।’
এদিকে পদ্মা সেতুর সর্বশেষ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবার পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে সাড়ে ৯৮ ভাগ। বাকি যে এক মাসের কিছু বেশি সময় রয়েছে তার মধ্যে বাকি দেড় শতাংশের কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা সেতুর মূল সেতুতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে গত ২৯ এপ্রিল, শুক্রবার বিকাল ৪টার দিকে। সেতু এখন যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। সেতুতে বাতি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজ চলছে। আগামী মাসের মাঝামাঝিতে সেতু আলোকিত হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এখন যেসব টুকিটাকি কাজ বাকি রয়েছে, তা আগামী জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।
এখন সেতুতে সাইন, সঙ্কেত ও মার্কিং বসানোর কাজ চলছে। সেতুর সীমানা দেয়ালের ওপর স্টিলের রেলিং বসানোরও কাজ শুরু হয়েছে। সেতু বিভাগের সূত্র জানায়, সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ চলছে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হচ্ছে। দুটি ম্যুরালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি থাকবে। জুনে সেতুতে যান চলাচল উদ্বোধনের লক্ষ্য নিয়ে দিন-রাত কাজ চলছে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সেতুতে এখন যেসব টুকিটাকি কাজ আছে, তা আগামী জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
পদ্মা সেতুর সর্বশেষ অগ্রগতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতুর প্রায় ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ কাজ শেষ। প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ শেষ হয়েছে ৯২ শতাংশ। সেতুর দুপাশে প্রস্তুত টোলপ্লাজাও। যদিও টোল আদায়ের সরঞ্জাম বসানোর কাজ বাকি।
এদিকে পদ্মা সেতুর টোল আদায় ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ বছরের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে সেতু বিভাগ। এ কাজ পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সেতুর ভায়াডাক্টে কার্পেটিংয়ের কাজ, সেতুর সড়কে সাইন মার্কিং, রোডমার্কিং ও সাইড সিগন্যালের কাজ বাকি আছে। সেতুতে যুক্ত গ্যাস পাইপলাইন ও ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের কাজও শেষ হয়নি। বাকি আছে মূল সেতুতে আলোকসজ্জার জন্য বসানো ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুতের তার লাগানোর কাজও। তবে এসব কাজও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং আগামী ২৫ জুনের মধ্যেই সম্পন্ন করা হবে।
টোল নির্ধারণও চূড়ান্ত হচ্ছে : গত মাসের শেষ নাগাদ সেতুর টোলহার চূড়ান্ত করার জন্য একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত টোলহার অনুসারে, পদ্মা সেতু পারাপারে বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ এবং মাঝারি ট্রাকে ২ হাজার ৮০০ টাকা লাগবে। পদ্মা ফেরি পারাপার হতে যানবাহনের যে পরিমাণ টোল দিতে হয়, এর দেড়গুণ বেশি দিতে হবে সেতু দিয়ে পারাপারের জন্য। এ মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত টোলহার অনুমোদন দিতে পারেন। এরপর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
এ ছাড়া মোটরসাইকেল পারাপারের জন্য টোল ধরা হয়েছে ১০০ টাকা, যা ফেরিতে লাগে ৭০ টাকা। কার বা জিপ গাড়ি পারাপারে টোল ৭৫০, ফেরিতে লাগে ৫০০ টাকা। পিকআপের টোল ১২০০, ফেরিতে লাগে ৮০০ টাকা। মাইক্রোবাসের টোল ১৩০০, ফেরিতে লাগে ৮৬০ টাকা। ছোট বাসের জন্য টোল ১৪০০, ফেরিতে লাগে ৯৫০ টাকা। মাঝারি আকারের বাসের জন্য টোল ২০০০, ফেরিতে লাগে ১৩৫০ টাকা। বড় বাসের জন্য টোল ২৪০০, ফেরিতে লাগে ১৫৮০ টাকা। ছোট ট্রাকের (৫ টন পর্যন্ত) টোল ১৬০০, ফেরিতে লাগে ১০৮০ টাকা। মাঝারি ট্রাকের (৫-৮ টন) টোল ২১০০, ফেরিতে লাগে ১৪০০ টাকা। মাঝারি ট্রাকের জন্য (৮-১১ টন) ২৮০০, ফেরিতে লাগে ১৮৫০ টাকা। বড় ট্রাকের জন্য (৩ অ্যাক্সেল পর্যন্ত) ৫৫০০, ফেরিতে লাগে ৩৯৪০ টাকা।
একনজরে পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। গতকাল পর্যন্ত খরচ হয়েছে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকার মতো। সেতু চালুর আগে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। তবে ব্যয় বাড়বে কি না এবং বাড়লে কত বাড়তে পারে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকায় সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখনও রেললাইন বসানো শুরু হয়নি। যানবাহন চালুর পর রেললাইন বসানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া রেললাইনের পাশে গ্যাসপাইপ যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রেললাইন মেরামতে হাঁটার রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে পদ্মা সেতু। এই সেতুর মাধ্যমে মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সেতুর কাজ কয়েক বছর এগোয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর থেমে থাকা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে। ২০১৩ সালের ৪ মে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই চলছে সেতু নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় প্রথম স্প্যান। ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেকদফা প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে।