স্টাফ রিপোর্টার : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, প্রতিষ্ঠার নবম বছরেই নৌ পুলিশ একটা শক্তিশালী অবস্থানে এসেছে। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল নৌপথ, নৌঘাট ও নৌবাণিজ্য ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দেয়া। নৌ পুলিশ আছে বলেই আজ অনেক সফলতার গল্প শুনছি। মৎস্য ও নৌ প্রাণীজ সম্পদে ভরপুর হয়েছে দেশ। বন্ধ হয়েছে জলদস্যুতা ও ডাকাতির ঘটনা।
রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত নৌ পুলিশের ৯ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
নৌ পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সোমবার (১৪ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪ টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নৌ পুলিশ জাটকা ইলিশ মাছ ধরা বন্ধে কাজ করছে। যে কারণে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে।
নদী থেকে বালু উত্তোলন এখন একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে, তবে তত্রতত্র নয়৷ এই জায়গায় কাজ করছে নৌ পুলিশ।
মন্ত্রী বলেন, নদীপথে ডাকাতি, অপহরণ, জেলে ধরে ধরে নিয়ে আটকে রাখার ঘটনা ঘটতো। নৌ পুলিশের আভিযানিক কার্যক্রমের কারণে নৌ ডাকাতি বন্ধ হয়েছে। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে নৌ পুলিশ ও র্যাবের কারণে।
মৎস্যখাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় নৌ পুলিশের ভুমিকার কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, আমাদের মৎস্য আহরণ ও মৎসখাতে অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে নৌ পুলিশকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আমরা নৌ পুলিশকে আরও বেগবান হতে হবে। এজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নৌ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা দরকার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এক সময় কাজ করেছে নৌ পুলিশ। সে দৃশ্য বদলেছে। মৎস্য ও নৌ প্রাণিসম্পদ রক্ষা, মৎস্য আহরণ বৃদ্ধিতে নৌ পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে করোনাকালে তিন দেশ মৎস্য আহরণে বড় কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। তারমধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। আমরা নৌ পুলিশকে বিশেষ সহযোগিতা করতে পারি না। তবে তারা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করছেন। দেশকে সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া এগিয়ে নেয়া যায় না।
পৃথিবীর ৫১টা দেশে মাছ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। মৎস্যজাত পণ্য, নৌ ও সামুদ্রিক উপকরণও রপ্তানি করা হচ্ছে। এসবই হচ্ছে নৌ পুলিশ কর্তৃক নৌ পথের নিরাপত্তা ও কার্যক্রমের কারণে।
অনুষ্ঠানে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। ৭ হাজার পথ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। নৌপথকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গঠন করা হয়েছে বিশেষায়িত ইউনিট নৌ পুলিশ।
তিনি বলেন, শুধু হালদা নয়, নৌ বানিজ্য ও আভ্যন্তরীণ নৌ পথকে নিরাপদ করেছে নৌ পুলিশ৷ ৯০ শতাংশের ওপরে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে নৌ পুলিশের সহযোগিতায়। নদী রক্ষায় সব সময় নৌ পুলিশকে ডাকলে পাওয়া গেছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা রক্ষার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা অনস্বীকার্য।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি এমপি বেনজির আহমেদ বলেন, নৌ পুলিশ মৎস্য ও নৌ প্রাণিসম্পদ রক্ষা, মৎস্য আহরণ নির্বিঘ্ন করা, মা মাছ ধরা বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মাছে-ভাতে বাঙালি স্বার্থকতা তখনই স্বার্থক হবে যখন মা মাছ ধরা বন্ধ হবে। নৌ পুলিশের আধুনিকায়ন দরকার। ইঞ্জিন চালিত নৌ যান চলাচল বন্ধ করা উচিত। ইঞ্জিনের পাখায় অনেক মাছ মরে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে অনেক নৌপথে বাঁধ বা বাধা সৃষ্টি করে জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। এতে ডিম পাড়ার মতো মাছের অস্তিত্ব থাকে না। এবিষয়ে নজর দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, নদীপথে আগে এতো পোনামাছ ধরা, দস্যুতা ছিল না। এখন নৌ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রক্ষা ও নদীপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিধি বেড়েছে। নদী কমিশন গঠন করেছে সরকার। নৌ পুলিশের গতি ও সক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, নৌ পুলিশ আভিযানিক সফলতা দিয়ে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রক্ষায় নৌ অঞ্চলের মানুষের সহযোগিতা ও আস্থা অর্জন করেছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, ঐতিহ্যবাহী নদীগুলো রক্ষার নকশায় নৌ পুলিশ বড় ভৃমিকা পালন করছে। সীমিত সংস্থাপন স্বত্ত্বেও আমরা চেষ্টা করছি। সরকারের সময়োচিত উদ্যোগের কারণে নদী, হাওর বিল খালে মৎস্য উৎপাদন বেড়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ২০ বছর ধরে হালদা নদী নিয়ে গবেষণা করছি। হালদা নদী রক্ষা জরুরি। নদী মাতৃক দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও নেই নদী ব্যবস্থাপনা। তবে ২০২০ সালে হালদা নদীতে মৎস্য ডিম উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে। এক্ষেত্রে নৌ পুলিশের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তিনি বলেন, হালদা নদীর পাড়ে তামাক চাষ মৎস্য চাষে বাধা তৈরি করেছিল। সেখানে হস্তক্ষেপ করেছে নৌ পুলিশ। সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ডলফিন হত্যা কমে এসেছে। হালদা পাড়ের মানুষের পক্ষ থেকে নৌ পুলিশকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
নৌ পুলিশের কার্যক্রম ও এর সফলতা সমস্যার নানা দিক তুলে ধরে সভাপতির বক্তব্যে প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ইলিশ ও নদীর সব ধরনের মাছ সংরক্ষণে নৌ পুলিশ কাজ করে। সরকারের নির্দেশনায় মা ইলিশ রক্ষায় রাত দিন কাজ করে নৌ পুলিশ। চলতি বছরে ইলিশের উৎপাদন ২ লাখ মেট্রিক টন ধরা হলেও আমার মনে হয় ৬ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছবে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ইলিশ উৎপাদন বেশি হবে বলে আশা করছি। ইলিশসহ অন্যান্য মাছের উৎপাদনও বেড়েছে।
মা ইলিশ সংরক্ষণে নৌ পুলিশের কিছুটা বেগ পেতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় জেলেদের সঙ্গে মারামারি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এখনো আমাদের কিছু পুলিশ সদস্য আহত আছেন।
নৌ পুলিশ প্রধান আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে মাছের রপ্তানি আগের তুলনায় বেড়েছে। এই সেক্টরে আরও বেশি কাজ করতে পারলে বেশি বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
নদী এমন একটি মাধ্যম যেখানে ট্রাফিক জ্যাম নেই। নদীতে অভিযানের খরচও তুলনামূলক কম হয়। পরিবহন ব্যয়ও কম।
নৌ পুলিশের প্রধান বলেন, নদীকে বাঁচাতে হবে, নদী দূষণ করা যাবে না। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। নদীর মাঝে বাঁশ-কাঠ পোতা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে করে নদীর নাব্যতার সমস্যা হয়। নদীকে যত নিরাপদ করতে পারবো ততবেশি নদী থেকে আমরা লাভবান হবো।
তিনি বলেন, নৌযানের কিছু সংকট রয়েছে। মন্ত্রণালয় আমাদের নৌ যানের সংকট নিরসন করলে আরও বেশি কাজ করতে পারবে নৌ পুলিশ। আমরা চাই বাংলাদেশের নদী রক্ষায় নৌ পুলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।