বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি নোভার্টিস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের সিংহভাগ শেয়ার দেশীয় প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি গুরুতর বিতর্কের মুখে পড়েছে। সরকারি অংশীদারিত্ব থাকা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তরে অস্বচ্ছতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি স্বার্থ উপেক্ষার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
নোভার্টিস বাংলাদেশে সরকারের ৪০ শতাংশ শেয়ারের জিম্মাদার বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)। কোম্পানির সংঘবিধি অনুযায়ী, বিদেশি অংশীদার শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে বিসিআইসি’র তা ক্রয়ের প্রথম অধিকার ছিল।
এ বছরের গত ৭ জানুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় বিসিআইসিকে ‘সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণ করে’ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিলেও, অভিযোগ উঠেছে যে বিসিআইসি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান এই নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর নোভার্টিসের ১৯০তম বোর্ড সভায় বিসিআইসি’র প্রতিনিধি পরিচালকরা শেয়ার ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সম্পাদিতব্য সমঝোতা স্মারক (MoU) দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার মাত্র একদিন পর ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি ১৯১তম বোর্ড সভায় সেই সমঝোতা স্মারক পর্যালোচনা না করেই শেয়ার হস্তান্তরের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এরও আগে, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত বিসিআইসি’র নিজস্ব বোর্ড সভায় শেয়ার হস্তান্তরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শুধুমাত্র ‘অবহিত’ করা হয়।
শেয়ারের অবমূল্যায়ন ও সরকারি রাজস্ব ক্ষতি
৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নোভার্টিসের প্রতিটি শেয়ারের নিট সম্পদ মূল্য (NAV) ছিল ৯৪৫.৭৩ টাকা। এমন লাভজনক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার উদ্যোগ না নিয়ে বিসিআইসি’র নিষ্ক্রিয় অবস্থানকে সরকারি স্বার্থবিরোধী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, বাজার মূল্যের পরিবর্তে একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে শেয়ারের বিক্রয় মূল্য কম দেখানো হয়েছে। এর ফলে, নোভার্টিসের মোট সম্পদের মূল্য কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো হয়েছে এবং সেখানে থাকা বিসিআইসি-এর ৪০% শেয়ারের মূল্যও আনুপাতিক হারে কমে গেছে, যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের সরাসরি ক্ষতি। এই কম মূল্য দেখানোর ফলে সরকারের সরাসরি রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, যা গেইন ট্যাক্স হিসেবে সরকারের পাওয়ার কথা ছিল।
আইনি ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা চলমান থাকা সত্ত্বেও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস এরই মধ্যে নোভার্টিসের ব্যবস্থাপনায় কার্যত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নোভার্টিসের পণ্য রেডিয়েন্টের নিজস্ব সফটওয়্যার সিস্টেমের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে এবং নোভার্টিসের কারখানায় রেডিয়েন্টের নতুন যন্ত্রপাতি প্রবেশ করানো হয়েছে বলেও জানা গেছে। এই ঘটনাগুলো এমন এক সময়ে ঘটছে যখন শেয়ার হস্তান্তরের আইনি প্রক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার চূড়ান্ত অনুমোদন বাকি।
তদন্ত ও স্বাধীন মূল্যায়নের অপরিহার্যতা
এই গুরুতর অনিয়মের প্রেক্ষাপটে, বিশ্লেষক ও আইনজীবীরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দিচ্ছেন। প্রথমত, শেয়ার হস্তান্তরের সময় বিসিআইসি’র তৎকালীন চেয়ারম্যানের ভূমিকা ও গৃহীত পদক্ষেপগুলোর একটি নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, একটি স্বাধীন অডিট ফার্মের মাধ্যমে শেয়ারের যথাযথ মূল্যায়ন করে এর প্রকৃত বাজার মূল্য নির্ধারণ করা আবশ্যক। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন শেয়ারের অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়নের অভিযোগ নিষ্পত্তি হবে, তেমনই সরকারের কতটা আর্থিক সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, তার একটি স্বচ্ছ চিত্র পাওয়া যাবে।