দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক গণ-অভ্যুত্থান দেখা গেছে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার আরাগালয় (জনতার সংগ্রাম) আন্দোলন একজন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেয়।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র জনতার আন্দোলন কয়েক দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটায়। পাকিস্তান রাস্তায় সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে টলতে থাকে। আর এবার পালা নেপালের।
হিমালয়ান প্রজাতন্ত্র নেপাল কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অস্থিরতার মুখে পড়েছে। কাঠমান্ডু ও অন্যান্য বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে প্রবল বিক্ষোভের ঝড়। এর নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত জেনারেশন জেড বা জেন-জি।
দুর্নীতি, ব্যর্থ শাসন এবং হঠাৎ করে ডিজিটাল স্বাধীনতার ওপর হামলার মিশ্রণ এই আন্দোলনের জ্বালানি। সেখানে এ পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শত শত মানুষ। সেনাবাহিনী এখন রাস্তায়।
ধারণা করা হচ্ছে, হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে। শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভাঙছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। এমনকি সংসদ ভবনের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছে।
এসব দৃশ্য পুরো অঞ্চলকে নাড়া দিয়েছে। নেপাল নামের যে দেশটিকে বাইরে থেকে অনেকেই শান্ত একটি পর্যটন স্বর্গ বলে ভাবেন, আজ সে দেশ গণবিপ্লবের ময়দানে পরিণত হয়েছে।
এই অস্থিরতার স্ফুলিঙ্গ ছিল সরকারের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তটি হলো দুই ডজনেরও বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব আর এক্স (আগের টুইটার) এক রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেবল টিকটক টিকে ছিল, কারণ তারা সরকারের নিবন্ধন নীতি মেনে নিয়েছিল। সরকারের ব্যাখ্যা ছিল—বিধি লঙ্ঘন, ঘৃণামূলক বক্তব্য ও অনলাইন অপব্যবহারের কারণে এগুলো বন্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু তরুণ নেপালিদের কাছে এটি ছিল স্রেফ সেন্সরশিপ। তাঁরা এটিকে নিজেদের মতপ্রকাশ, সংগঠন গড়ে তোলা এবং ডিজিটাল যুগে বেঁচে থাকার অধিকারের ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছেন।
শুরুতে নির্দিষ্ট স্থানে সমাবেশ হলেও দ্রুত তা গণমিছিলে রূপ নেয়। এটি ছড়িয়ে পড়ে কাঠমান্ডু, পোখারা, বিরাটনগর ও ভরতপুরে। আন্দোলনকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে দেন। সরকারি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এমনকি সংসদ ভবনও আক্রান্ত হয়।
কঠোর দমননীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র এসবের জবাব দিয়েছে। রাস্তায় গুলি ছোড়া হয়েছে। রাবার বুলেট আর টিয়ারগ্যাসে বাতাস ভরে গেছে। লাঠিপেটায় বহু মানুষ রক্তাক্ত হয়েছে। সরকারি বাহিনীর ধরপাকড়ের পর হাসপাতালে শয্যা ফুরিয়ে গিয়েছিল, কারণ আহতদের ভিড় সামলানো যাচ্ছিল না। কারফিউ আর রাস্তা অবরোধে এখনো পাড়া-মহল্লা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। শহরের কেন্দ্রস্থলে সেনা নামানো হয়েছে।
তবুও প্রতিবাদ থামেনি। বরং তা আরও বড় হয়েছে। আরও ক্ষুব্ধ হয়েছে—যেন তরুণ প্রজন্ম বিশ্বাস করে বসেছে, সরকার কেবল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার জন্যই তাদের ওপর দমন চালাচ্ছে। যা শুরু হয়েছিল ডিজিটাল অধিকারের দাবিতে, তা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সংগ্রামে পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতাসীন অভিজাতরা ভেবেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করলেই বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তার উল্টোটা হয়েছে। এটাই তরুণদের জন্য হয়ে উঠেছে স্লোগান ও সংগ্রামের ডাক।
‘দুর্নীতি বন্ধ করো, সামাজিক মাধ্যম নয়’—এটিই এখন আন্দোলনের মূল স্লোগান। এটি প্রকৃত ক্ষতকে সামনে এনেছে। সেই ক্ষতটি হলো, দশকের পর দশক ধরে নেপালের রাজনীতিকে গ্রাস করা দুর্নীতি আর দায়মুক্তির সংস্কৃতি।
নেপালের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিতিশীলতা ও কেলেঙ্কারিতে ভরা। সরকার গড়া ও ভাঙা যেন এক অন্তহীন খেলা। জোট ভেঙে যায় তুচ্ছ প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। নেতারা সহজেই দলবদল করেন। কিন্তু যে জিনিস কখনো বদলায় না, তা হলো দুর্নীতির কালো ছায়া।
পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায়, বাংলাদেশে, আর এখন নেপালে—তরুণ প্রজন্মই ব্যর্থ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। যে সামাজিক মাধ্যমকে একসময় তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেওয়া হতো, সেটাই হয়ে উঠেছে সংগঠন, দুর্নীতি ফাঁস আর বিদ্রোহের হাতিয়ার।
শুধু ২০২৫ সালেই একের পর এক চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ বিষয়ক মন্ত্রী ঘুষের অভিযোগে পদত্যাগ করেছেন। এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন।
বিমানবন্দর নির্মাণে জালিয়াতি, নেপাল টেলিকমে অর্থ আত্মসাৎ, অভিবাসন দপ্তরে চাঁদাবাজি—এসব কেলেঙ্কারিতে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালান ও শরণার্থী প্রতারণা কেলেঙ্কারিতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখেছে, বড় নেতাদের আসলে কোনো সাজা হয় না। সেখানে দেখা যায়, তদন্ত দীর্ঘায়িত হয়, নিচুতলার কর্মীরা শাস্তি পান, অথচ ক্ষমতাবানরা বেঁচে যান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের পোশাক-গয়না প্রদর্শনের ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাঁদের ব্যঙ্গ করে বলা হচ্ছে—‘নেপো কিডস’। #NepoKids এবং #PoliticiansNepoBabyNepal হ্যাশট্যাগ সেখানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
একটি তীব্র তুলনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে—‘তাদের সন্তানরা গুচির ব্যাগ নিয়ে ফেরে, আমাদের সন্তানরা কফিনে ফেরে।’