মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ পাশাপাশি চলে। কখনও আমরা আনন্দে ভাসি, কখনও আবার দুঃখের পাহাড়ে চাপা পড়ি। কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়—কোনো কষ্ট স্থায়ী নয়, প্রতিটি পরীক্ষার সঙ্গেই আছে আল্লাহর বিশেষ সহজীকরণ ও রহমত। এ কথাটি সর্বাধিক স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে কোরআনে, “অবশ্যই কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি। নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গেই রয়েছে স্বস্তি।” (সুরা শরাহ, আয়াত: ৯-১০)
এই আয়াত শুধু আধ্যাত্মিক শিক্ষা নয়, বরং আধুনিক জীবনের জন্যও গভীর অনুপ্রেরণার উৎস।
আয়াতের প্রেক্ষাপট
মক্কা জীবনের শুরুর দিকে নবী মুহাম্মদ (সা.) কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ছিলেন। চারপাশ থেকে নির্যাতন, অবিশ্বাসীদের তিরস্কার, দাওয়াতের প্রতিবন্ধকতা—সবকিছু যেন হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল। এমন সময় আল্লাহ এই সান্ত্বনাদায়ক আয়াত অবতীর্ণ করেন, যাতে প্রিয় নবী (সা.) বুঝতে পারেন—প্রতিটি কষ্টের পর আল্লাহর সহজীকরণ অনিবার্য। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১০/৪৫৩, দারুস সালাম, রিয়াদ: ২০০৩)
মূল শিক্ষাটি কী?
১. কষ্ট স্থায়ী নয়: আল্লাহ এখানে বলেননি, “কষ্টের পর স্বস্তি আছে।” বরং বলেছেন—কষ্টের সঙ্গে সঙ্গেই স্বস্তি আছে। অর্থাৎ কষ্ট ও স্বস্তি একঙ্গে চলে। অন্ধকার যেমন সূর্যের আগমনকে জানান দেয়, তেমনি বিপদও কল্যাণের দুয়ার খুলে দেয়।
২. একই কষ্টে বারবার স্বস্তি: আয়াতটিতে ‘কষ্ট’ শব্দটি নির্দিষ্ট করে একবার ব্যবহার করা হয়েছে (‘উস্র), আর ‘স্বস্তি’ শব্দটি এসেছে সাধারণভাবে দু’বার (ইউস্র)। অনেক মুফাসসির বলেন—এর মানে হলো, একটি কষ্টের জন্য অন্তত দুটি স্বস্তি আল্লাহ দেন। (আল-কুরতুবি, আল-জামি লি আহকামিল কোরআন, ২০/২২৭, দারুল কুতুব আল-মিসরিয়া, কায়রো: ১৯৬৪)
হাদিসের আলোকে
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন—
“জেনে রাখো, সাহায্য আসে ধৈর্যের সাথে, মুক্তি আসে কষ্টের সাথে, আর নিশ্চয়ই সহজি আসে কষ্টের সাথে।” (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৬)
এ হাদিস কোরআনের আয়াতেরই বাস্তব ব্যাখ্যা।জীবনের বাস্তবতায় শিক্ষা
১. ব্যক্তিগত জীবনের সংকটে
অর্থনৈতিক চাপ, চাকরির অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের জটিলতা—আমাদের সবার জীবনেই কোনো না কোনো কষ্ট আছে। কিন্তু এই আয়াত আমাদের শেখায়—হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, কারণ সহজি আমাদের অদৃশ্য সঙ্গী।
২. জাতীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে
একটি জাতি যখন সংকটে পড়ে—যেমন দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—তখন এই আয়াত বিশ্বাসীদের মনে দৃঢ় আশাবাদ জাগায় যে, পরিবর্তনের দ্বার খোলা আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—মুসলিম উম্মাহ যখনই ধৈর্য ও চেষ্টা করেছে, তখনই তারা উন্নতি অর্জন করেছে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব
মনোবিজ্ঞান বলছে, আশা (hope) মানুষকে সংকট মোকাবিলায় শক্তি জোগায়। কোরআনের এই আয়াত বিশ্বাসীকে সর্বোচ্চ আশাবাদী মনোভাব দেয়—কোনো ব্যথা অর্থহীন নয়, প্রতিটি দুঃখই নতুন সম্ভাবনার সূচনা।
সাহাবাদের জীবনে প্রতিফলন
খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানরা যখন ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলেন, তখনও তারা আশায় বুক বাঁধেন—এই সংকটই বিজয়ের সূচনা হবে। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটেছিল। তা ছাড়া হিজরত-এর কষ্টের পর মুসলমানরা মদিনায় শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
মোটকথা, মানুষের পরিকল্পনা সীমিত, কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা সীমাহীন। যখন আমরা জীবনের বোঝা টানতে ক্লান্ত হই, তখন এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিটি অন্ধকার রাতের পরেই ফজরের আলো ফোটে।