পুরাণের ঋষি-মুনিরাও স্বর্গের সুন্দরী অপ্সরাদের প্রেমের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেননি। তপস্যাভঙ্গ করার জন্য কামকলার ফাঁদ পাততেন ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভারা। কলিযুগেও সেই ফাঁদ এড়াতে পারলেন না সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা। অপ্সরা না হলেও সুন্দরী তরুণীর মধু-ফাঁদে পা দিয়ে এক ভয়ঙ্কর যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লেন একদল বৌদ্ধভিক্ষু।
বৌদ্ধভিক্ষুদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাঁদের যৌনতার ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেল করার অভিযোগে মঙ্গলবার গ্রেফতার হয়েছেন এক থাই তরুণী। থাইল্যান্ডের পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর প্রকাশ্যে এসেছে কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। আর তাতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে কমপক্ষে ৯ জন বৌদ্ধভিক্ষুর বিরুদ্ধে।
এই কেলেঙ্কারির নেপথ্যে যাঁর নাম উঠে এসেছে তিনি হলেন ৩০ বছর বয়সি উইলাওয়ান এমসাওয়াত। ‘মিস গল্ফ’ নামেই তিনি অধিক পরিচিত। এই থাই তরুণী ভিক্ষুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের স্থাপন করার পর তাঁদের ভয় দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা আদায় করে নিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। ব্যাঙ্ককের উত্তরে নন্থাবুরিতে একটি বিলাসবহুল বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় উইলাওয়ানকে। তার বিরুদ্ধে তোলাবাজি, অর্থ পাচার এবং চুরির অভিযোগ এনেছে থাই পুলিশ।
বৌদ্ধ মঠগুলি সম্পর্কে তাই জনগণ বিশেষ শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করেন। আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভিক্ষুরা থাইল্যান্ডের জনসাধারণের কাছে সম্ভ্রমের পাত্র। স্বভাবতই এই যৌন কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরই জনসমাজে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করেছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে থাইল্যান্ডের পুলিশ জানিয়েছে, ‘মিস গল্ফ’ নাম্নী ওই তরুণী অন্তত ৯ জন ভিক্ষুর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলেন। বৌদ্ধভিক্ষুরাও তাঁদের ব্রহ্মচর্যের ব্রত লঙ্ঘন করে তরুণীর সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন বলে অভিযোগ। তরুণীর শয্যাসঙ্গী হওয়ার খেসারতও দিতে হয়েছে মোটা টাকার বিনিময়ে।
গোপনে তোলা ভিক্ষুদের সঙ্গমের মুহূর্তের হাজার হাজার ছবি ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেছিলেন উইলাওয়ান। প্রথমে তিনি ভিক্ষুদের প্রেমের ফাঁদে জড়াতেন। তার পর টেনে নিয়ে যেতেন শয্যায়। সঙ্গমের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হয়ে যেত গোপনে। পরে সেই ছবিকে হাতিয়ার করে ভিক্ষুদের ব্ল্যাকমেল করে অর্থ রোজগার করতেন তরুণী।
এই ভাবে ভয় দেখিয়ে ৯ জনের থেকে ১০৩ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা তরুণীর বাড়িতে বৌদ্ধভিক্ষুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকার ৮০ হাজারেরও বেশি ছবি এবং ভিডিয়ো খুঁজে পেয়েছে।
সামান্য সরকারি ভাতা ও জনগণের দানের উপর নির্ভর করা বৌদ্ধভিক্ষুরা এই বিপুল টাকা পেতেন কোথা থেকে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আরও একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। তরুণীর পকেটে ঢোকা ১০৩ কোটি টাকার পুরোটাই এসেছে মঠের দানবাক্স ও অ্যাকাউন্ট থেকে! যৌনতৃপ্তির মূল্য চোকাতে মঠের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জনগণের দানের টাকা নয়-ছয় করেছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা, এমনটাই তদন্তে উঠে এসেছে।
আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর বিভিন্ন মঠের ৯ জন ভিক্ষুর থেকে গেরুয়া পোশাক পরার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বহিষ্কৃত সন্ন্যাসীদের কয়েক জন উচ্চপদস্থ ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। সরকার আইন লঙ্ঘনকারী সন্ন্যাসীদের জরিমানা-সহ জেলের ঘানি টানানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন।
বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ রাজা নিজের আসন্ন ৭৩তম জন্মদিনের উৎসবে যোগদান করতে আসা ৮০ জনেরও বেশি সন্ন্যাসীর নিমন্ত্রণ বাতিল করে দিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর। ৮১ জন ভিক্ষুকে উচ্চতর উপাধি দেওয়ার যে রাজকীয় আদেশ জারি করেছিলেন তা-ও প্রত্যাহার করেছেন তিনি।
কী ভাবে এত বড় একটি যৌন কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁস করল থাই পুলিশ? জুনের দিকে একটি ঘটনা পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওয়াট ট্রি থোটসাথেপ নামের একটি মঠের ভিক্ষু নিখোঁজ হওয়ার পর তদন্তে নামে পুলিশ। উইলাওয়ানের ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়ে মঠত্যাগ করেন ওই ভিক্ষু। পুলিশ জানিয়েছে যে, টাকা দিতে না পেরে তিনি তরুণীর হাত থেকে বাঁচতে মঠ ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে যান।
পরে পুলিশ জানতে পারে, ওই সন্ন্যাসীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ার পর উইলাওয়ান দাবি করেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা এবং সন্তানের ভরণপোষণের জন্য তিনি ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। তদন্তকারীরা তরুণীর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাঁর ফোন উদ্ধার করেন। সেখানে টাকা পয়সার লেনদেন সংক্রান্ত প্রচুর তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
সমাজমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে বৌদ্ধভিক্ষুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এই মধু-ফাঁদের নায়িকা। এক জন সন্ন্যাসী দাবি করেছেন যে তরুণীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে ছিল এবং তাঁর কাছ থেকে একটি গাড়িও উপহার পেয়েছিলেন ওই সন্ন্যাসী। পরে তিনি জানতে পারেন অন্য এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা শুরু করেছেন তাঁর প্রেমিকা। সব দেখেশুনে নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেন তিনি।
টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন উইলাওয়ানও। পুলিশের কাছে জানান যে সন্ন্যাসীরা তাঁকে এক দিনেই ৯০ হাজার ডলার পর্যন্ত দিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি মনের সুখে কেনাকাটা করেছেন। সন্ন্যাসীদের ভয় দেখিয়ে যে টাকা আদায় হত তার বড় একটি অংশ দিয়ে ওই তরুণী অনলাইনে জুয়া খেলতেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
এই কেলেঙ্কারি জনসমক্ষে আসার ফলে তাই বৌদ্ধধর্মের নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে যে তারা সন্ন্যাসীদের নিয়মকানুন পর্যালোচনা করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করবে। থাইল্যান্ডে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বৌদ্ধ। সেখানে ভিক্ষুরা অত্যন্ত সম্মানিত। অনেক তাই পুরুষও ভাল কর্মফল অর্জনের জন্য সাময়িক ভাবে ভিক্ষু হিসেবে নিযুক্ত হন। ভিক্ষুদের এই অসদাচারণের বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে জনমানসেও।
বৌদ্ধসঙ্ঘের নিয়মানুযায়ী সন্ন্যাসীরা ২২৭টি কঠোর নিয়ম মেনে চলেন। হস্তমৈথুন, নারীদের স্পর্শ, এমনকি তাঁদের কাছ থেকে সরাসরি জিনিসপত্র ধরাও নিষিদ্ধ ব্রহ্মচর্য পালনকারীদের। ভিক্ষুরা সাধারণত দান এবং মাসিক ১৭০ ডলারের সামান্য ভাতার উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করেন। এ ছাড়া বক্তৃতা, আশীর্বাদ এবং অনুষ্ঠানের জন্য সামান্য কিছু অর্থ পান তাঁরা।
এই যৌন কেলেঙ্কারি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রথম কেলেঙ্কারি নয়। ২০১৭ সালে পুলিশ ব্যাঙ্ককের উত্তরে ওয়াট ধম্মাকায়া মন্দিরে অভিযান চালায়। সেই সময় ৩.৩ কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল মঠের অধ্যক্ষকে। এই বছরের শুরুতে আর এক সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে জুয়ার তহবিলের জন্য প্রায় ১ কোটি ডলার আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
বৌদ্ধধর্মের বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলতে শুরু করেছেন যে, মঠ ও ভিক্ষুদের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। মংকোল সুদাথিপ নামের এক তরুণ ট্যাক্সিচালক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগে সন্ন্যাসীদের সম্মানের চোখে দেখা হত। এই ধরনের ঘটনা যত বাড়ছে ততই তাঁরা জনগণের সম্মানের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছেন। মংকোল বলেন, ‘‘আমি এখন হাসপাতাল এবং স্কুলে দান করি। মন্দিরে দান করার চেয়ে এটি সঠিক বলে মনে হয়।’’
থাইল্যান্ডের পুলিশ প্রধান কিত্রাত পানফেট দাবি করেছেন যে এই কেলেঙ্কারিটি সমস্ত বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। কেবল কয়েক জন ব্যক্তি নিয়মভঙ্গ করেছেন। অনেকে মনে করছেন ভিক্ষুদের কাজকর্মে মানুষ তাঁদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারেন কিন্তু বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা এখনও অনুগামীদের পথ দেখায়।