মোস্তাফিজুর রহমান: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই চমক দেখান জাদুকরী কাটার দিয়ে। এখন তো আইপিএলেও বড় তারকা বাংলাদেশের বাঁহাতি এই পেসার।
তাসকিন আহমেদ: ৯ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স অনেক। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে বল হাতেও নিজেকে নির্ভরযোগ্য করে তুলেছেন।
নাহিদ রানা: বল হাতে ঘণ্টায় ১৪৯ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলেছেন। ১৪৫-১৪৬ কিলোমিটার গতি তো নিয়মিতই তোলেন। বাংলাদেশ দলে এমন গতিময় বোলার বিশ্ব ক্রিকেটের জন্যই একটা চমক।
এই তিনজনের বাইরেও বাংলাদেশের পেস–ভান্ডার এখন বেশ সমৃদ্ধ। একটা সিরিজে তিন সংস্করণে ভিন্ন পেসারদের খেলিয়েও দেখা যায় কয়েকজন পেসার সুযোগ পাননি, যাঁরা চাইলে খেলতে পারতেন কোনো না কোনো সংস্করণে। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখবেন, বাংলাদেশের পেস বোলিং আক্রমণ নামে যতটা ভারী, সবার পারফরম্যান্স নামের সঙ্গে সুবিচার করে ততটা নয়।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এবার টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ মিলিয়ে বাংলাদেশের পেসারদের মোট উইকেট ১৭টি। এর মধ্যে তাসকিন আর তানজিমেরই ৬টি করে ১২টি। অন্যদিকে টেস্ট, ওয়ানডেতে ৮টি করে উইকেট নিয়ে শ্রীলঙ্কার পেসার আসিতা ফার্নান্ডো একাই নিয়েছেন ১৬টি উইকেট। পুরো সিরিজে আসিতার মতো ধারাবাহিক বাংলাদেশের কোনো পেসারই হতে পারেননি। একটু ব্যতিক্রম বলতে হবে শুধু তানজিমকে।
অবশ্য তানজিম ছাড়া বাকি পেসারদের ম্যাচ খেলানোতেই ধারাবাহিকতা রাখা যাচ্ছে না। কাউকে একের বেশি দুই সংস্করণে খেলাতে গেলেই নানা সমীকরণ মেলাতে হয়। ‘ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট’ কথাটা এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে দল নির্বাচনী সভায় পেস বোলারদের হিসাব মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় নির্বাচক কমিটিকে। একাদশের বোলিং কম্বিনেশন ঠিক করতে গিয়ে একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্টকেও।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই টেস্টে বাংলাদেশ খেলিয়েছে তিন পেসারকে। প্রথম টেস্টে হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা। পরের টেস্টে হাসানের সঙ্গে নাহিদের পরিবর্তে দুই বছর পর চোট কাটিয়ে ফেরা ইবাদত হোসেন। এই তিন পেসারের মধ্যে নাহিদ আর ইবাদতকে চাইলেও পরপর দুই টেস্টে খেলানো যায় না তাঁদের চোটপ্রবণতার জন্য। নাহিদের ক্ষেত্রে তো ওয়ানডের কথাও মাথায় রাখতে হয়। একই সিরিজে টেস্ট, ওয়ানডে দুটিই থাকলে আগে থেকে পরিকল্পনা করে নিতে হয় তাঁকে কোন ম্যাচ খেলিয়ে কোন ম্যাচে বিশ্রাম দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন, সিরিজের মধ্যে দলের আর কোনো পেসার আকস্মিক চোটে পড়ে গেলে হিসাব ঠিক রাখা কতটা কঠিন হয়ে পড়ে। ওয়ানডের বোলারদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এবার পেসারদের মধ্যে ওয়ানডে সিরিজের তিন ম্যাচেই খেলেছেন তানজিম ও মোস্তাফিজ। প্রথম ও শেষ ওয়ানডেতে তাঁদের সঙ্গে তাসকিন। তাসকিনের ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্টের সুযোগে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে খেলেছেন হাসান মাহমুদ।
ক্যারিয়ারজুড়েই নানা রকম চোটের সঙ্গে সখ্য তাসকিনের। সর্বশেষ সমস্যা গোড়ালির হাড় বেড়ে যাওয়া, অস্ত্রোপচারেও যেটির পুরোপুরি সমাধানের নিশ্চয়তা নেই। খেলতে হচ্ছে বিশ্রাম নিয়ে ও ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতেও তাসকিনকে টেস্ট ক্রিকেটে খেলানোটা কঠিন হবে বলে মনে করে নির্বাচক কমিটি। যেসব সিরিজে শুধু টেস্টই থাকবে, এ রকম সিরিজেই শুধু লাল বলের বিবেচনায় থাকতে পারেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই গতির ঝড় তুলে সবার দৃষ্টি কাড়া নাহিদ রানাকেও চোট–শঙ্কার কথা মাথায় রেখে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই খেলায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছে। গত জানুয়ারিতে সর্বশেষ বিপিএলের সময় চোট প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে নাহিদ বলেছিলেন, ‘মানুষ যুদ্ধে নামলে গুলি খাইতে হয়। ক্রিকেট খেলতে এলে ইনজুরিতে পড়বই।’ তাই বলে তো আর জেনেবুঝে ১৪৮-১৪৯ কিলোমিটার গতির একজন বোলারকে টানা ম্যাচ খেলিয়ে চোটের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যায় না। চোটে পড়ার অতীত ইতিহাসের কারণে ইবাদত আর মোস্তাফিজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মোস্তাফিজের বেলায় পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাবও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। ওয়ানডেতে তাঁকে তাই চতুর্থ পেসার হিসেবে দলে নেন নির্বাচকেরা, যদিও অভিজ্ঞতা আর নামে ভারী বলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডেতেই তিনি খেলেছেন। পেসারদের নামের ভারের কারণেই কিনা টিম ম্যানেজমেন্ট অনেক সময় তাঁদের পড়তি পারফরম্যান্স দেখেও দেখে না। তবে পাল্লেকেলেতে কাল প্রথম টি-টোয়েন্টির দলে মোস্তাফিজের না থাকাটা বিস্ময়করই। আইপিএল অভিজ্ঞতার সুবাদে মোস্তাফিজকে খেলানোর জন্য টি-টোয়েন্টিই প্রথম পছন্দ হওয়ার কথা। তাহলে কি ওয়ানডেতে হতাশাজনক বোলিং-ফিল্ডিংয়ের পর টিম ম্যানেজমেন্টও আর তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না! মোস্তাফিজ যে এই ম্যাচ খেলার মতো ফিট ছিলেন, সেটি বোঝা গেছে ম্যাচের আগে মাঠে তাঁর বোলিং অনুশীলন দেখেই।
গতকাল একাদশে না থাকা আরেক পেসার শরীফুল ইসলামকে নিয়েও সব সময় চোটের ভয় থাকে। কুঁচকিতে পুরোনো সমস্যা আছে বাঁহাতি এই পেসারের। এই সমস্যা যত দিন পুরোপুরি দূর না হচ্ছে, শরীফুলকেও হয়তো লাল বলের দল থেকে দূরেই রাখবে নির্বাচক কমিটি। বাকি থাকেন শুধু তানজিম, একমাত্র তাঁকেই এখন পর্যন্ত তিন সংস্করণে নিশ্চিন্তে খেলানো যাচ্ছে। ভালো লাইন-লেংথের কারণে খালেদ আহমেদও হয়তো সাদা বলে সুযোগ পেলে সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারবেন, যদিও কোচদের দৃষ্টিতে তিনি মূলত লাল বলেরই বোলার।
বাংলাদেশ দলে পেসারদের দীর্ঘ সারিও তাই সংকট মোচনের আভাস দিচ্ছে না। প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন তবু তাকিয়ে পরের প্রজন্মের পেসারদের দিকে, ‘আমাদের আরও কিছু তরুণ পেসার আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের পরিণত করে তুললে এই সংকট কিছুটা দূর হবে।’