আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (সা.)-কে পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছিলেন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় বের করে আনার জন্য, মানবজাতির জন্য দয়া ও মমতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি কিশোর বয়স থেকে এমন মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বড় হয়েছেন।
পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতায়, মানুষের বিপত্তারণে ও সংকট নিরসনে, দুর্বলদের সাহায্যে ও মজলুমদের উদ্ধারে আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি শিষ্টের লালন ও অশিষ্টের দমন, মানুষের জন্য কল্যাণ প্রতিষ্ঠা ও অকল্যাণ রহিত করাকে আল্লাহ তাআলার বিশেষ ইবাদত বলে বিবেচনা করেছেন। তাঁর এই বাণী সর্বদা স্মর্তব্য: ‘সৃষ্টিজগৎ আল্লাহ তাআলার পরিবার; আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত সেটাই, যা তাঁর পরিবারের জন্য কল্যাণকর।’ (ইমাম বায়হাকি, শুআবুল ইমান, হাদিস: ৭,৪৪৪)
তার কারণ এই যে সমাজে যদি মানুষে মানুষে মিল না থাকে, বিভেদ ও বৈষম্য থাকে, শক্তিশালী শ্রেণি যদি লুণ্ঠন ও উৎপীড়নের সুযোগ পায় এবং দুর্বল শ্রেণি যদি নিরাপদ ও স্বস্তিবোধ না করে, তবে একটি বৈশ্বিক উম্মাহ ও বিশ্বসভ্যতা নির্মাণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর সুস্থ ও সুন্দর সমাজ নির্মাণ তখনই সম্ভব, যখন সমাজের প্রত্যেক সদস্য থাকে ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্দীপিত, অন্যায় ও দুর্নীতিমুক্ত, পারস্পরিক কল্যাণ ও সৌভাগ্যকামী।
সৃষ্টিজগৎ আল্লাহ তাআলার পরিবার; আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত সেটাই, যা তাঁর পরিবারের জন্য কল্যাণকর।
ইমাম বায়হাকি, শুআবুল ইমান, হাদিস: ৭,৪৪৪
ইসলামের শক্তির গোপনীয় রহস্য এই যে তা মানুষের মধ্যে পরোপকারের ও পরার্থপরতার চেতনা বদ্ধমূল করে দেয়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন অগ্রপথিক। তিনি তরুণ বয়সেই সত্যবাদী ও আমানতদারি, মিসকিন-দরিদ্রদের সাহায্য এবং আত্মমানবতার সেবার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন। নবুয়তপ্রাপ্তির আগে তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি এমনই ছিল।
আল্লাহর রাসুল (সা.) স্বভাবগতভাবেই কল্যাণপ্রেম ও মানবতাবোধের অধিকারী ছিলেন। মানুষের বিপদ–আপদে সবার আগে এগিয়ে যেতেন, সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করতেন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় রাখতেন, মেহমান এলে যথাযথ আপ্যায়ন করতেন। তাঁর এসব গুণ সম্পর্কে সবচেয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.)।
প্রথমবার ওহি নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, ‘তারপর তিনি তাঁর স্ত্রী খাদিজার কাছে এলেন এবং বললেন, আমাকে চাদর দিয়ে জড়িয়ে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে জড়িয়ে দাও।
অবশেষে তাঁর ভয় কেটে গেল। তিনি খাদিজার কাছে ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, শপথ আল্লাহর, আমি নিজের জীবন সম্পর্কে আশঙ্কাবোধ করছি।
তখন খাদিজা (সান্ত্বনা দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে) বললেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, এমনটা কখনো হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা কখনো আপনাকে অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন, সর্বদা সত্য কথা বলেন, আপনি অক্ষমের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের উপার্জন করে সাহায্য করেন, অতিথিবৃন্দের আপ্যায়ন করেন এবং প্রকৃত বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করেন।’ (সহিহ বুখারি, অধ্যায়: হাদিস: ৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬০)
নবীজীর বয়স তখন ২০ বছর। উকাজের বাজারে একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এর এক পক্ষে ছিল কুরাইশ ও কিনানা গোত্র এবং অপর পক্ষে ছিল কায়স আইলান গোত্র। ঘটনার সূত্রপাত এভাবে—কিনানা গোত্রের বাররাদ নামের এক ব্যক্তি কায়স আইলান গোত্রের তিন ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল।
নবীজীর বয়স তখন ২০ বছর। উকাজের বাজারে একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এর এক পক্ষে ছিল কুরাইশ ও কিনানা গোত্র এবং অপর পক্ষে ছিল কায়স আইলান গোত্র। নবীজি সেই যুদ্ধ ঠেকাতে অবদান রেখেছিলেন।
এ সংবাদ উকাজের বাজারে পৌঁছে। ফলে দুই পক্ষই উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দিনব্যাপী তাদের যুদ্ধ চলে। তারপর তারা সন্ধিচুক্তি করতে সম্মত হয়। নবীজী এই চুক্তির সময় উপস্থিত ছিলেন এবং একটি আসন্ন ভয়াবহ যুদ্ধ ঠেকাতে অবদান রেখেছিলেন। (সফিউর রহমান মুবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৪৯-৫০, দারুল হিলাল বৈরুত, ২০০২)
কিশোর বয়স থেকেই নবীজি (সা.)-এর চরিত্রে মানবকল্যাণ, দরিদ্রদের সাহায্য, বিপদাপন্ন মানুষের সাহায্য, এতিম-বিধবা-আর্ত মানুষের সেবায় এগিয়ে আসা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য বদ্ধমূল ছিল। এ কারণে ‘হিলফুল ফুজুল’ চুক্তি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন।
অনবরত হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহের ফলে আরবের অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এক অসহনীয় পরিবেশ ও দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল সবাই। হারবুল ফিজার (ফিজার যুদ্ধ) থেকে কুরাইশদের ফিরে আসার পর এ চুক্তি লিপিবব্ধ হয়েছিল।
অবশ্য এর পেছনে একটি ঘটনা ছিল। ইয়েমেনের জুবাইদ এলাকা থেকে এক ব্যক্তি পণ্যসামগ্রী নিয়ে মক্কায় এসেছিলেন। আস বিন ওয়ায়িল তার পণ্য কিনে নেন; কিন্তু মূল্য পরিশোধ না করে সব মাল নিজের কাছে আটক রাখেন। ওই অসহায় জুবাইদি ব্যক্তি তখন কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে বিচার দাবি করেন। কিন্তু আস বিন ওয়ায়িল নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ার কারণে তাঁদের কেউ-ই লোকটির কথায় কর্ণপাত করেননি। ফলে লোকটি কাবার চত্বরে গিয়ে ফিহরের বংশধর ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম ধরে ধরে উচ্চ স্বরে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকেন।
জুবাই বিন আবদুল মোত্তালিব লোকটি আওয়াজ শুনে দৌড়ে যান এবং জিজ্ঞাসা করেন এ অসহায় লোকটির কী হয়েছে? ফলে বনু হাশিম, বনু জুহরা ও বনু তাইম বিন মুররা গোত্রের নেতৃস্থনীয় ব্যক্তিরা আবদুল্লাহ বিন জুদ্ইনের ঘরে সমবেত হলেন। তাঁরা এ মর্মে একটি চুক্তি সম্পাদন করলেন, ‘আমরা সবাই মিলে অত্যাচারিত ও মজলুমের সহায়তা করব; প্রত্যেক প্রাপককে তার প্রাপ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’
তারপর তাঁরা আস বিন ওয়ায়িলের কাছে আসেন এবং ওই লোককে তাঁর পণ্য ফিরিয়ে দেন। তাঁরা এই চুক্তির নাম রাখেন হিলফুল ফুজুল। (আত–তাবাকাতুল কুবরা, ১/৮২; ইবনে কাসির, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ১/২৫৯)
চুক্তির অঙ্গীকারনামা ছিল এমন:
দেশের অশান্তি দূর করার জন্য আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
ভিনদেশি মানুষের জান, মাল, ইজ্জত, সম্মান রক্ষার জন্য আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
দুর্বল, দরিদ্র ও আর্ত মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে আমরা কখনোই কুণ্ঠাবোধ করব না।
আল্লাহর রাসুল (সা.) জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমকে সাহায্য করার জন্য এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য এ চুক্তিকে অংশগ্রহণ করলেন।
নবুয়তপ্রাপ্তির পর তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি আমার তরুণ বয়সেই আমার চাচাদের সঙ্গে কল্যাণকামী মানুষদের চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই চুক্তি ভাঙার জন্য কেউ যদি আমাকে একটি রক্তবর্ণের উটও দিত, তবু তা করতাম না। আজও যদি কেউ আমাকে এমন চুক্তিতে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায়, তাহলে আমি সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে যাব।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, ২/২২০; সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/১৩৩)
আমি তরুণ বয়সেই আমার চাচাদের সঙ্গে কল্যাণকামী মানুষদের চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই চুক্তি ভাঙার জন্য কেউ যদি আমাকে একটি রক্তবর্ণের উটও দিত, তবু তা করতাম না।
মুসতাদরাকে হাকিম, ২/২২০; সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/১৩৩
একবার মক্কায় দুর্ভিক্ষ হলে কুরাইশরা দুর্ভোগে পড়ে। আবু তালিবের পরিবারের সদস্য ছিল অনেক বেশি। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর চাচা আবু তালিবের সংকট বুঝতে পারলেন। তাঁর চাচা আব্বাস বিন আবদুল মোত্তালিব (রা.)-এর কাছে গেলেন। তিনি ছিলেন বনু হাশিমের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একজন।
নবীজী তাঁকে বলেন, ‘হে চাচা, আপনার ভাই আবু তালিবের পরিবারে সদস্য অনেক বেশি। আর আপনি তো দেখছেনই মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের শিকার। আমার সঙ্গে চলুন তাঁর কাছে যাই; তাঁর পরিবারের দায়িত্বভার লাঘব করি। আমি তাঁর পরিবারের একজন সদস্যকে নিই এবং আপনিও একজন সদস্যকে নিন এবং আমরা তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আব্বাস (রা.) বললেন, ঠিক আছে, চলো।’
তাঁরা আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমরা আপনার পরিবারের ব্যাপারে কিছু দায়িত্বভার গ্রহণ করতে চাই। সংকট শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করব।’ আবু তালিব বললেন, ‘তোমরা আকিলকে ছাড়া অন্য যে কাউকে নিতে পারো।’ আকিল ছিলেন তাঁর প্রিয়পুত্র।
আল্লাহর রাসুল (সা.) আলীকে গ্রহণ করলেন এবং আব্বাস (রা.) জাফরকে গ্রহণ করলেন। আবু তালিব ও তাঁর পরিবারের জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সাহায্য-সহযোগিতা তাঁর যুবক বয়সের মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/২৪৫; উয়ুনুল আসার, ইবনে সায়্যিদিন নাস, ১/১২৪)
আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর যুবক বয়সে যেভাবে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে গিয়েছেন, একইভাবে নবুয়তপ্রাপ্তির পরও মানুষের প্রতি তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন। উদারতা ও মহানুভবতা তাঁর বয়সের সঙ্গে বা দায়িত্বপ্রাপ্তির সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন, আত্মমানবতার সেবায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিলেন।