রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মুবারক সীরাত বা জীবনী অধ্যয়ন শুধু জ্ঞানবৃদ্ধির বিষয়ই নয়, এটি একজন মুসলিমের দ্বীনি প্রয়োজন। কারণ, মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা প্রিয়নবী (স.)-কে স্পর্শ করেনি। ব্যবহারিক, আধ্যাত্মিক, ইহলৌকিক, পারলৌকিক— সবকিছুই তাঁর জীবন ও সাধনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ফলে তাঁর জীবনাদর্শ মানবজাতির জন্য অনুকরণীয়; জীবনপথে আলোর মশাল ও দিকনির্দেশনা স্বরূপ।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনীতে রয়েছে অনুপম আদর্শ, তাদের জন্যে যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সুরা আহজাব: ২১)
ইসলামি শরিয়তে কোন আমল উত্তীর্ণ—তা যাচাইয়ের নিখুঁত মানদণ্ড হলো নবীজির সীরাত। আর যেই আমল সীরাত ও সুন্নতের মানদণ্ডে ঠিক না, সেটি ইসলামে অশুদ্ধ ও বর্জনীয় বলে বিবেচিত। এক্ষেত্রে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার বক্তব্য উল্লেখযোগ্য, যা খতিবে বোগদাদি (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাওয়ী ওয়া আদাবিস সামে’ এর মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন-‘নিঃসন্দেহে এটা সর্বজন স্বীকৃত বিষয় যে— রাসুল (স.)-এর সীরাত হলো ইসলামের সকল বিষয়ের সত্যতা যাচাইয়ের অন্যতম মানদণ্ড। সুতরাং, সকল আমলকে তার জীবনাচার, স্বভাব-চরিত্রের নিক্তিতে মেপে দেখতে হবে। যা কিছু এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখবে, তাই সত্য। আর যা কিছু সামঞ্জস্য রাখবে না তা অসত্য।’
কাজেই সঠিক ও শুদ্ধ উপায়ে আমল করতে চাইলে সীরাত পাঠের বিকল্প নেই। সীরাত পাঠে কোরআন অনুধাবনও সহজ হয়। কারণ, তাঁর জীবনই ছিল কোরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ তাফসির। একজন মুসলমান হিসেবে প্রাণাধিক প্রিয়পাত্র ও ভালোবাসার পাত্র হওয়া উচিত প্রিয়নবী (স.)। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসুলের (স.) এই ভালোবাসাকে আমাদের উপর আবশ্যক করে দিয়ে বলেন— قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُم من ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘বলো, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার (রাসুল) অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে-ইমরান: ৩১)
রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ‘সেই আল্লাহর শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালবাসার পাত্র হই।’ (সহিহ বুখারি: ১৪)
যিনি যতো বেশি সীরাতের গভীরে অবগাহন করবেন, তিনি তত বড় রাসুলপ্রেমিকে পরিণত হবেন। নিখুঁত জীবনের সন্ধান পাবেন। মানবিক হয়ে উঠবেন। গঠিত হবে মজবুত ঈমান। আনাস (রা.) বলেন, এক লোক রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে দু’পাহাড়ের মাঝামাঝি ছাগলগুলো চাইলে তিনি দিয়ে দিলেন। অতঃপর লোকটি তার গোত্রের কাছে প্রত্যাবর্তন করে বলল, হে আমার জাতি ভাইয়েরা! তোমরা ইসলাম কবুল করো। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদ (স.) অভাবের আশঙ্কা না করেই দান করেন। আনাস (রা.) বলেন, যদিও মানুষ শুধু ইহকালের উদ্দেশ্যেই ইসলাম গ্রহণ করে তবুও ইসলাম গ্রহণ করতে না করতেই ইসলাম তার কাছে পৃথিবী এবং পৃথিবীর সকল প্রাচুর্যের চাইতে অধিকতর প্রিয় হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম: ৫৯১৫)
তাই মানবজীবনে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি এই সীরাত। আধুনিক নয়, বরং সর্বাধুনিক জীবনপদ্ধতির গ্যারান্টি নবীজির পবিত্র জীবনী। সীরাত অনুসরণ-অনুকরণ এবং দৈনন্দিন জীবনে এর বাস্তবায়ন ছাড়া কারো পক্ষেই পার্থিব কিংবা অপার্থিব কোনোরকম সফলতার আশা করা বোকামি। ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, দুনিয়া-আখেরাতের একমাত্র সফলতা আর সকল সৌভাগ্য রাসুলের পদাঙ্ক অনুসরণের মাঝেই নিহিত। তাই যে ব্যক্তি নিজের জীবনে কল্যাণ, সফলতা আর সৌভাগ্য কামনা করে, সে যেন নবীজির সীরাত অধ্যয়ন করে। এতে করে সে রাসুলকে চিনতে পারবে। রাসুলের সত্যিকার অনুসারী হতে পারবে। (জাদুল মা’আদ: ১/৩৬)
একজন মুমিন হয়ে শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়ে যদি তাঁর জীবনীটা না পড়তে পারি, তাঁর সম্পর্কে না জানতে পারি, এর চেয়ে দুঃখ ও লজ্জাজনক দুর্ভাগ্য আমাদের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বেশি বেশি সীরাত পাঠ এবং তা থেকে কল্যণলাভের তাওফিক দান করুন। বিশ্বনবী (স.)-এর আশেক হিসেবে কবুল করুন। আমিন।