উপ-সম্পাদকীয় ডেস্ক: পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি, কিন্তু মিঠা পানির পরিমাণ খুবই কম। তাই পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা সারা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীতে প্রাপ্ত মিষ্টি পানির প্রায় ৭০ ভাগই ফসল উৎপাদনে কৃষকরা ব্যবহার করেন। শিল্প-কলকারখানা ব্যবহার করা হয় ২০ ভাগ এবং শতকরা ১০ ভাগ মিষ্টি পানি ব্যবহার করা হয় গৃহস্থালির কাজে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সবুজ বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে হাজারো ছোট-বড় নদী। কেউ বলে নদ-নদী বাংলাদেশের হূৎপিণ্ড। কেউ বা বলে ফুসফুসের মতো কাজ করে। যে যাই বলুক নদ-নদীর গুরুত্ব অনুধাবন করতে শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই দেশটির নদ-নদী বিধৌত পলিমাটি দিয়ে নিজেকে করেছে উর্বর, ফুল ফল আর ফসলে করেছে দেশকে সমৃদ্ধ। নদী গ্রামীণ জনপদকে কর্মচঞ্চল রাখতে একদিকে যেমন অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে তেমনি গতিময় শহুরে জীবনকে আরও বেগবান করতে নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সরকারের রুলস অব বিজনেসের অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রযোজ্য বিষয়গুলো হলো— ১, নদী এবং নদী অববাহিকার উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ; ২. সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, নিষ্কাশন এবং নদীভাঙন ক্ষেত্রে সাধারণ নীতি প্রণয়ন ও কারিগরি সহায়তা প্রদান; ৩. সেচ, বন্যা-পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ স্থাপনা, বন্যার কারণ এবং বন্যার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কিত সকল বিষয়াবলি; ৪. নদীর অববাহিকা প্রকল্প এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মৌলিক এবং ফলিত গবেষণা পরিচালনা; ৫. বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পানিসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা; ৬. সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক কমিশন এবং কনফারেন্স; ৭. বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নদী ড্রেজিং, খাল খনন এবং রক্ষণাবেক্ষণ। খাল খনন কর্মসূচির আওতায় খালের উপর পানির নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ; ৮. ভূমি সংরক্ষণ, নিষ্কাশন এবং জলাবদ্ধতা বিষয়ক কার্যাবলি; ৯. পানি সংরক্ষণ, জলাধার নির্মাণ, বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ বিষয়ক কার্যাবলি; ১০. ভূমি পুনরুদ্ধার, মোহনা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যাবলি; ১১. লবণাক্ততা ও মরুকরণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অন্যতম।
দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজের কমান্ড এলাকার ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এরিয়া পুনর্বাসন ও সমপ্রসারণ প্রকল্প সমপ্রতি একনেকে পাস হয়েছে। এই প্রকল্পের কমান্ড এরিয়া এক লাখ চার হাজার হেক্টর জমিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি সরবরাহ করা হবে। তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকের সেচের পানি সরবরাহ করতে ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেকেন্ডারি ও টারসিয়ারি ক্যানেল নির্মাণ করা হবে। সেচ-সুবিধার কারণে ফসলের নিবিড়তা ২৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অতিরিক্ত এক লাখ টন ধান উৎপাদন হবে এবং অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে প্রায় ছয় লাখ টন। বর্তমান যার বাজার মূল্য এক হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা পাড়ের মানুষের দুর্দশা লাঘবে আট হাজার ২০০ কোটি টাকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তিস্তা রিভার কমিপ্রহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট নামে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১১৫ কিলোমিটার এলাকায় ব্যাপক খনন, স্থায়ী তীর রক্ষাসহ পৌনে ২০০ বর্গকিলোমিটার জমি উদ্ধার করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে তিস্তা পাড়ের মানুষের ভাগ্য। ফসল উৎপাদনে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। আগে শেষ এর জন্য ডিজেল ও বিদ্যুতচালিত মোটরের পাম্পের সাহায্যে পানি দিতে বিঘায় খরচ হতো এক হাজার ৫০০ টাকা, আর এখন সেচ প্রকল্পের পানিতে প্রতি একরে খরচ হবে ৪৮০ টাকা। তা ছাড়া পানি পেতে কোনো ঝামেলা নেই। সেচের পানি প্রকৃতি হতে প্রাপ্ত এবং বৃষ্টির উপরি ভাগের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।
কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, ১৯৭০-৭১ সালে প্রাকৃতিক নির্ভর আমন আর আউস থেকে মোট উৎপাদনের বেশির ভাগ আসতো। মাত্র ২০ শতাংশ ফসল আসতো বোরো থেকে। আর এখন দেশে ৬০ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে। ৩০ শতাংশ আসে আমন থেকে এবং ১০ শতাংশ আসে আউস থেকে। এ সময় বোরোর মোট উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আটগুণ। এ সময় বন্যার পানিনির্ভর আউশের চাষ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। আমন চাষ কমেছে ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের হিসাব মোতাবেক কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প আছে ১৩ লাখ ৭৯ হাজারটি। এর মধ্যে ডিজেলচালিত ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি। বিদ্যুতে চলে মাত্র এক লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে এক লাখ ৫০ হাজার, ডিজেলের চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেল এবং ২৬ হাজার বিদ্যুতে চলে। বোরো মওসুমে ১৭ লাখ সেলো টিউবওয়েল কার্যকর থাকে। ১৯৭০-৭১ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিলো এক কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৫৩ লাখ টন। যদিও এ সময়ের ব্যবধানে প্রতি বছর দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমেছে আট লাখ হেক্টর করে। ১৯৭২ সালে একজন মানুষ প্রতিদিন খাদ্য পেতেন ৪৫৬ গ্রাম, তা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৬৬৭ গ্রাম। দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য মতে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে চীনের অবস্থান প্রথম আর বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম।
তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, জিকে সেচ প্রকল্প, মুহুরী সেচ প্রকল্প, বরিশাল সেচ প্রকল্প প্রভৃতি এ প্রকল্পের সুবিধা সমপ্রসারণ করে দেশকে খাদ্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতাই নয়, দুই কোটি টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কৃষিবান্ধব কর্মসূচি, প্রকল্প বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষতা, মেধাবী একঝাঁক প্রকৌশলীর ক্লান্তিহীন কর্মযজ্ঞ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক ফসল উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী, সিনিয়র সচিব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকের পরামর্শ ও নিবিড় মনিটরিং ফসল উৎপাদনে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকে আরো দৃশ্যমান করবে। ৬৪ জেলা ছোট নদী, খাল ও জলাশয় খনন ও পুনর্খনন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। আট হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের মাধ্যমে দুই হাজার ৬১২টি ছোট নদী, খাল ও জলাশয় খনন করা হবে। এর মধ্যে ২১২টি ছোট নদী, দুই হাজারটি খাল এবং ৪০০টি জলাশয় রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
লেখক : উপ-মন্ত্রীর একান্ত সচিব, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়