সোমবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৬ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর-পশ্চিম পাশে মাইলস্টোন স্কুলের মাঠে ঘটল একটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা।
এটি ছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি চীনা তৈরি ফাইটার জেট, মডেল F-7BG। জনবহুল এলাকায়, বিশেষ করে বিমানবন্দরসংলগ্ন অঞ্চলে এমন ফাইটার জেট দুর্ঘটনার নজির আগে পাওয়া যায়নি।
বিমানটির পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির (৭৮ বিএমএ লং কোর্স), সদ্য বিবাহিত এবং আগামী মাসেই তার পদোন্নতির কথা ছিল।
দুর্ঘটনার পর তৌকিরের মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে পাওয়া যায়। শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়—একটি পা ভেঙে যায়, কানে রক্তক্ষরণ হয়। যদিও শুরুতে তার পালস পাওয়া যাচ্ছিল, তবে শেষপর্যন্ত তিনি বাঁচতে পারেননি। আইসিইউ থেকে তিনি চিরবিদায় নেন।
এই দুর্ঘটনায় স্কুলের বেশ কিছু শিক্ষার্থীও নিহত ও গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। অনেকের শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বার্ন ভিকটিম সামলাতে সিএমএইচসহ অন্যান্য হাসপাতাল হিমশিম খাচ্ছে।
বিমান বাহিনীতে পাইলটদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন থাকে—একদিন ফাইটার পাইলট হওয়া। কঠিন প্রশিক্ষণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়া পেরিয়ে একটি কোর্সের ১০ জনের মধ্যে মাত্র ৪-৫ জনই ফাইটারে সুযোগ পায়।
তৌকির তার বেসিক ট্রেনিং শেষে নির্ধারিত ফ্লাইং ঘণ্টা পূরণ করে একা উড়ার জন্য কোয়ালিফাই করেন তিন দিন আগে। নিয়ম অনুযায়ী কোয়ালিফাই করার দিনেই প্রথম একক ফ্লাইট হয়, তবে আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় তা তখন সম্ভব হয়নি।
অবশেষে সোমবার ছিল সেই প্রতীক্ষিত দিন। তৌকিরের প্রশিক্ষক প্রথমে তাকে নিয়ে ডুয়েল ককপিটে কিছু অনুশীলন করান। পরে প্রশিক্ষক নেমে যান এবং তৌকির একাই বিমান চালানোর অনুমতি পান।
প্রথম একক ফ্লাইটে স্কোয়াড্রন জুড়ে থাকে উত্তেজনা। প্রশিক্ষক থাকেন রানওয়ের পাশে ওয়্যারলেসসহ, যেন প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া যায়।
তৌকিরের ট্যাক্সি ও টেকঅফ ছিল নির্ভুল। কিন্তু ৫-৭ মিনিট পর বিমানটির অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেন প্রশিক্ষক। দেখা যায়, বিমানটি উচ্চতা হারাচ্ছে এবং দক্ষিণমুখী হয়ে পড়ছে। বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, বিমানটিতে একযোগে ইঞ্জিন ফেইল, কন্ট্রোল লস ও রেডিও ফেইল হয়েছে।
তবে শেষ মুহূর্তে তৌকির হয়তো কিছু একটা করেছিলেন, যার ফলে বিমানটি সরাসরি বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক পার্কিংয়ে না পড়ে অন্যদিকে চলে যায়—এতে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
বিমান বাহিনীতে নিয়ম হলো—নতুন ফাইটার পাইলটদের প্রথম একক ফ্লাইটে সবচেয়ে ভালো অবস্থার বিমানটি দেওয়া হয়। তাহলে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেন ঘটল, তা এখনো রহস্য।
অনেকে বলেন, পুরনো বিমান মানেই ঝুঁকিপূর্ণ নয়—কারণ নির্ধারিত ফ্লাইট আওয়ার শেষে প্রতিটি ফাইটার জেট ওভারহল বা ফেইসআউট করা হয়।
তবু এই দুর্ঘটনা আমাদের কাঁদিয়েছে, প্রশ্ন তুলেছে, আবার ভাবিয়েছে। সকল নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আহত শিশুদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
লেখক:
উইং কমান্ডার (অবসরপ্রাপ্ত) মসিউর
এ ডি ডব্লিউ সি
(সাবেক ফাইটার কন্ট্রোলার, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী)