আখতার-উজ-জামান
সকল কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুবার্তাই বসন্ত ঋতু। নতুন রঙ, নতুন ফুল আর পাখির কলতান দেখে কবি সাহিত্যিকদের মনে ভেসে বেড়ায় নব দিগন্তে বাঙ্গালীর প্রাণে নতুন কিছু উপহার দিতে। কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসে সবার প্রাণে। বৃরাজির গায়ে ফুটে উঠে নবরূপের ছোঁয়া। বসন্ত যেমন শীতের জীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে নতুন করে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে তোলে, তেমনি আমাদের জীবনে সব ব্যর্থতা, সব ভুল বোঝাবুঝি দূর করে নতুন জীবনের প্রেরণায় জাগ্রত হতে হবে। বসন্ত যেভাবে সবাইকে আপন করে নেয়, ঠিক সেইভাবে সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে পারলেই নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারবেন। ফাল্গুনের এইদিনটি সবার ভাল কাটুক, ভালবাসায় ভরে উঠুক আপনার জীবন। বসন্ত বাতাস দোলা দেবে সবার মনে; সাজবে বাসন্তি সাজে। বসন্তরাণীর আগমনে মাতাল হবে সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা এই বাংলার প্রান্তর। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনেও লাগবে দোলা। পাতার আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা বসন্তের দূত কোকিলের মধুর কুহু কুহু ডাক। কবি মনে জেগে উঠবে নতুন নতুন সব পঙক্তি। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আজ এতো বর্ণিল সাজ। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। বাংলার আনাছে-কানাছে তরুন-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সীরা ঘুড়ে বেড়ায় এই ঋতুরাজ বসন্তে।
[[[শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই বসন্ত বরণে চলবে নানা আয়োজন। শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসবে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা। বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানেই একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের এ ঋতু বাসন্তী রঙে সাজায় মনকে, মানুষকে করে আনমনা। বাঙ্গালীর ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ দিনগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ।]]]
বসন্ত ষড়ঋতুর শেষ ঋতু। ফাল্গুন এবং চৈত্র মাস মিলে হয় এই ঋতুর আগমন। বসন্ত ঋতুর শুরুশীত চলে যাবার পর এবং গ্রীষ্ম আসার আগে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে কারণ পৃথিবী সূর্যের দিকে হেলে থাকে। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এই ঋতুতে ফুল ফুটে, নতুন গাছের পাতা গজায়, নতুন গাছের জন্ম হয়। এই সময় অনেক পশুপাখি মিলন ঘটায় এবং বাচ্চার জন্ম দেয়। আবার পৃথিবীর অনেক জায়গায় এই সময় বৃষ্টিও হয়। এর ফলে গাছপালা বেড়ে উঠে, ফুল ও ফলের পরবর্তী বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল বসন্তের আবেদনকে এভাবেই তুলে ধরেছেন। “হে কবি! নীরব কেন- ফাগুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?” আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক/ আজ বসন্ত’। সত্যিই আজ পয়লা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। শীতের রিক্ততা ভুলিয়ে আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে আজ ফাগুনের ছোঁয়া, আগুনরাঙা বসন্তের সুর। বসন্তের আমোদনে ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়া, রক্তিম পলাশ, শিমুল, কাঞ্চন পারিজাত, মাধবী, গামারী আর মৃদু গাঁদার ছোট ছোট ফুলের বর্ণিল রূপে চোখ জুড়াবে। বোটানিক্যাল গার্ডেন, রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডি লেক, বনানী লেক, মিন্টো রোড, হেয়ার রোড, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গণ ফুলে ফুলে বর্ণিল, উচ্ছল-উজ্জ্বল হয়ে উঠে ফাল্গুন এলে বাসন্তি হাওয়ায়।
বসন্ত অনেক ফুলের বাহারে সজ্জিত হলেও গাঁদা ফুলের রঙকেই এ দিনে তাদের পোশাকে ধারণ করে তরুণ-তরুণীরা। খোঁপায় শোভা পায় গাঁদা ফুলের মালা। বসন্তের আনন্দযজ্ঞ থেকে বাদ যায় না গ্রাম্যজীবনও। আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠাপুলির মৌতাতে গ্রামে বসন্তের আমেজ একটু বেশিই ধরা পড়ে। বসন্তকে তারা আরও নিবিড়ভাবে বরণ করে।
১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। বাঙালির নিজস্ব সার্বজনীন প্রাণের উৎসবে এ উৎসব এখন গোটা বাঙালির কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। বাংলায় বসন্ত উৎসব এখন প্রাণের উৎসবে পরিণত হলেও এর শুরুর একটা ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে, যা অনেকের অজানা।
মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। সে ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে।
বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। এছাড়া তরুণ-তরুণীরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ধানমন্ডি লেক, বলধা গার্ডেন মাতিয়ে রাখবে সারাদিন।
যেকোন ঋতু কিংবা বিশেষ দিনে দোলা দিতে থাকে বাঙ্গালীর মনে। তাই দুঃখ কষ্টকে পাত্তা না দিয়ে বাঙ্গালীর সব সময় এগিয়ে যায় এসব আনন্দের দিনগুলোতে। তাই বসন্তের সুবার্তায় প্রথম সকালে বাসন্তী রং শাড়ি, কপালে টিপ, হাতে চুড়ি, পায়ে নূপুর, খোঁপায় ফুল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়বে সব বয়সী বাঙ্গালীরা। বিশেষ করে তরুণীর দল চোখে পড়ার মতো। অন্যদিকে পাঞ্জাবি, ফতুয়া পরা তরুণরাও সঙ্গী হবে বসন্ত বরণের বিভিন্ন আয়োজনে। এদিনেই অসংখ্য রমনী বাসন্তী রঙে রাঙিয়ে তোলে গ্রাম-বাংলার পাশাপাশি সাড়ে চারশ বছরের ঢাকার রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশোভিত সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনেও লাগবে দোলা। প্রাণের টানে, আর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মন হয়ে ওঠে উত্তাল, বাঁধনহারা। বসন্ত নিয়ে যেনো তরুণদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরা পাতার শুকনো নুপুরের নিক্কন, প্রকৃতির মিলন সবই এ বসন্তেই। আবাল-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী বসন্ত উম্মাদনায় আজকে মেতে উঠবে। শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই বসন্ত বরণে চলবে ধুম আয়োজন।
শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসবে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা। বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানেই একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের এ ঋতু বাসন্তী রঙে সাজায় মনকে, মানুষকে করে আনমনা। বাঙ্গালীর ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ দিনগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আজ বেজে উঠবে সুরে সুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গান‘ফুলে ফুলে দুলে দুলে বহে কে বা মৃদু বায়ে/ কে জানে কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়।’ রেকর্ডে বেজে উঠবে লতা মুঙ্গেশকরের সেই গান-‘পাখি আজ কোন সুরে গায়/ কোকিলের ঘুম ভেঙে যায়/ আজ কোনো কথা নয়/ শুধু গান/ আরো গান/ আজ বুঝি দু’জনের মন/ কতো সুরে করে আলাপন/ আজ কোনো কথা নয়/ শুধু গান আরো গান…।’