নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছে। এই আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি দৃষ্টিকোণ হলো ইসলামী নারীবাদ এবং পশ্চিমা নারীবাদ। ইসলামী নারীবাদ নারীর অধিকারকে ইসলাম ধর্মের আলোকে বিশ্লেষণ করে, যেখানে ধর্মীয় বিধান অনুসারে নারীর মর্যাদা ও অবস্থানকে তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে, পশ্চিমা নারীবাদ মূলত নারীকে পুরুষের সমান অধিকার প্রদানের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশে পরিবর্তন আনার কথা বলে। এই নিবন্ধে আমরা ইসলামী নারীবাদ এবং পশ্চিমা নারীবাদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করব এবং দেখব কিভাবে এই দুটি আন্দোলন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে।
ইসলামে নারীর অধিকার নিয়ে প্রথমেই বলতে হয় যে, ইসলামে নারীকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কুরআন এবং হাদিসে নারীর প্রতি সম্মান, তাদের অধিকার, নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কুরআনে পুরুষ ও নারীকে সমান সত্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং আল্লাহ্ তাদের কাজ ও দায়িত্বের জন্য সমানভাবে বিচার করবেন বলে জানিয়েছেন। ইসলামী শরীয়াহ আইনে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রয়েছে; তারা নিজের সম্পত্তির মালিক হতে পারে, উত্তরাধিকার পেতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে এবং বিয়েতে নিজের সম্মতি দেওয়ার অধিকার রাখে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইসলামে নারীর স্বামী বা পরিবারের উপর নির্ভরশীলতা থাকার বাধ্যবাধকতা নেই।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, মুসলিম সমাজে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না, এবং সংস্কৃতিগত প্রভাব বা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে নারীরা তাদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। ইসলামী নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা নারীদের ক্ষমতায়নে সহায়ক হতে পারে এবং ধর্মীয় শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগেই নারীরা তাদের অধিকার ফিরে পেতে পারে। ইসলামী নারীবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ধর্মের মধ্যেই নারীর মুক্তি খোঁজা। তাদের মতে, ইসলামের মূল শিক্ষা অনুসরণ করলে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ইসলামী নারীবাদীরা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী শিক্ষার উপর জোর দেন এবং কুরআনের প্রেক্ষিতে নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে, পশ্চিমা নারীবাদ নারীর অধিকার নিয়ে এক দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। পশ্চিমা নারীবাদী আন্দোলন মূলত উনিশ শতকে শুরু হলেও, একবিংশ শতাব্দীতে এসে তা একটি ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা নারীবাদের মূল দাবি ছিল সমতা: নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা, কর্মক্ষেত্রে সমতা, শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের অবসান ঘটানো। বিশ শতকের নারী আন্দোলন বিশেষ করে ভোটাধিকার, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, এবং বৈবাহিক স্বাধীনতার অধিকারের জন্য জোর দেয়।
তবে পশ্চিমা নারীবাদ শুধুমাত্র সমতা নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরবর্তী সময়ে, এটি আরও গভীরে প্রবেশ করে নারীর শরীর ও যৌন স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু করে। নারীকে তার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া, যেমন সন্তান জন্মদান ও পরিবার পরিকল্পনার অধিকার, এবং কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই—পশ্চিমা নারীবাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নারীর শিক্ষার অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সম্পূর্ণ সমতার দাবি।
ইসলামী নারীবাদ ও পশ্চিমা নারীবাদের মধ্যে মূল পার্থক্য দেখা যায় তাদের দৃষ্টিকোণ ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে। ইসলামী নারীবাদে নারী অধিকার ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। তারা মনে করেন, ইসলাম ধর্ম নারীকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে, তা যথাযথভাবে অনুসরণ করলে নারীদের অধিকারের প্রশ্নেই কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে না। ইসলামী নারীবাদীরা প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যার বিপরীতে কুরআনের আরও প্রগতিশীল ব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীর সমতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, পশ্চিমা নারীবাদ ধর্মীয় মূল্যবোধের বাইরে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে চায়। তারা বিশ্বাস করে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে সবধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সেই লক্ষ্যেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে এই দুই আন্দোলনের মধ্যেও কিছু মিল দেখা যায়। উভয় আন্দোলনেরই মূল লক্ষ্য হলো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটানো। উভয় ক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান আচরণ নিশ্চিত করা এবং তাদের মর্যাদার প্রশ্নে সংগ্রাম করা হয়েছে। তবে পদ্ধতি ও দৃষ্টিকোণের ভিন্নতা এখানেই প্রধান ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দুটি নারীবাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলামী নারীবাদ বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে নারীর অধিকারকে সংযুক্ত করে একটি সমন্বিত চিন্তার বিকাশ ঘটানো সম্ভব। অন্যদিকে, পশ্চিমা নারীবাদও বাংলাদেশের শহুরে সমাজে এবং কিছু প্রগতিশীল মহলে প্রভাব ফেলেছে। কর্মক্ষেত্রে সমতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকারের ক্ষেত্রে পশ্চিমা নারীবাদের আদর্শগুলো অনেকাংশে গৃহীত হয়েছে। তবে দেশের গ্রামাঞ্চলে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখনও ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির প্রভাব প্রবল।
ইসলামী নারীবাদ এবং পশ্চিমা নারীবাদ উভয়েই নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে, কিন্তু তাদের লক্ষ্য ও পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণে দুটির মধ্যে এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা স্পষ্ট। ইসলামী নারীবাদ নারীকে ধর্মীয় দায়িত্ব ও অধিকারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যেখানে পশ্চিমা নারীবাদ ধর্মীয় বিধান থেকে মুক্ত হয়ে পুরোপুরি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের অধিকারের জন্য উভয় ধরণের নারীবাদের শিক্ষা গ্রহণ ও প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে একটি মধ্যপন্থা গ্রহণ করে যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সামাজিক প্রগতিশীলতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং
হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।