অন্ধ অনুকরণ মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং তাকে বিভ্রান্তির অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। কোরআন মজিদ এই অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার অনুসরণ করো। তারা বলে, না, আমরা তো তা–ই অনুসরণ করব, যার ওপর আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি। এমনকি যদি তাদের পূর্বপুরুষেরা কিছুই না বোঝে এবং হিদায়াত না পায়?’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৭০)
এই আয়াতের মতো আরও অনেক আয়াত কোরআনে এসেছে, যা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণের প্রতি নিন্দা প্রকাশ করে। তবে এই নিন্দা সব ঐতিহ্যের জন্য নয়; বরং সেই ঐতিহ্যের জন্য, যা সত্যের বিপরীত।
যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার অনুসরণ করো। তারা বলে, না, আমরা তো তা–ই অনুসরণ করব, যার ওপর আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি।
সুরা বাকারা, আয়াত: ১৭০
পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণ
কোরআন মজিদ অন্ধ অনুকরণের নিন্দা করেছে, বিশেষ করে যখন এটি আকিদা ও তাওহিদের বিষয়ে হয়। সুরা বাকারার ১৭০ নম্বর আয়াতটি মূলত আরবের মুশরিক ও কুরাইশের কাফিরদের সম্পর্কে নাজিল হয়েছিল, যারা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করত এবং আল্লাহ মহানের বিরুদ্ধে জ্ঞান ও প্রমাণ ছাড়াই কথা বলত। এমনকি তাদের কোরআনের অনুসরণ করতে বলা হলেও অগ্রাহ্য করে তারা বলত, ‘না, আমরা তা-ই অনুসরণ করব, যার ওপর আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি।’ তারা মূর্তিপূজা ও নেতাদের প্রতি আনুগত্যে অটল ছিল। (তানতাভি, আত-তাফসিরুল ওয়াসিত, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১৩)
এই অন্ধ অনুকরণ নিন্দনীয়, কারণ সব অনুকরণ ভালো নয়। আকিদা ও তাওহিদের বিষয়ে জ্ঞান ও বোঝার অভাবে পূর্বপুরুষদের পথ অনুসরণ করা ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কোরআনে এই অন্ধ অনুকরণকারীদের অহংকার, একগুঁয়েমি ও অজ্ঞতার প্রতি কঠোর নিন্দা প্রকাশ করা হয়েছে।
রাসুল (সা.) তাঁর সম্প্রদায়কে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ এবং শিরক ও অন্যান্য উপাস্যের উপাসনা ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; কিন্তু তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের গান গেয়ে বলত, ‘আমরা তাদের পথেই চলব।’ এই মানসিকতা শয়তানের প্রভাবে কলুষিত হয়েছিল। এই সমস্যা কেবল বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি ছিল হৃদয়ের গভীরে লুকানো একগুঁয়েমি ও কঠোরতা।
যখন কেউ একগুঁয়েমি ও অহংকারের পথ বেছে নেয়, তখন সে সত্য থেকে বিমুখ হয়। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়েরা তাদের নবীদের সঙ্গে এমনই করেছিল।
একটি সুস্থ মানুষের বুদ্ধি যখন সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য দেখে, তখন তার ‘ফিতরাত’ (সৃষ্টিগত স্বভাব) তাকে সত্যের দিকে নিয়ে যায় এবং মিথ্যা থেকে দূরে রাখে; কিন্তু যখন কেউ একগুঁয়েমি ও অহংকারের পথ বেছে নেয়, তখন সে সত্য থেকে বিমুখ হয়। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়েরা তাদের নবীদের সঙ্গে এমনই করেছিল।
‘বধির, মূক, অন্ধ, তাই তারা বোঝে না’
অন্ধ অনুকরণ ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, বিশেষ করে যখন পূর্বপুরুষেরা নিজেরাই ভ্রান্তি ও কুফরির মধ্যে থাকে। মহান আল্লাহ এই অন্ধ অনুকরণকারীদের বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘যারা কাফির হয়েছে, তাদের উপমা ওই ব্যক্তির মতো, যে এমন কিছুর প্রতি ডাকে, যা কেবল ডাক ও আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনে না। তারা বধির, মূক, অন্ধ, তাই তারা বোঝে না’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৭১) আল্লাহর দিকে মহানবীর আহ্বানের ক্ষেত্রে কাফিরদের উপমা এমন এক রাখালের মতো, যে তার ভেড়াদের ডাকে; কিন্তু তারা কেবল তার আওয়াজ শোনে, অর্থ বোঝে না।
ইমাম বাগাভি, মাআলিমুত তানযিল, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৭
ইমাম বাগাভি তাঁর তাফসিরে বলেন, ‘আল্লাহর দিকে মহানবীর আহ্বানের ক্ষেত্রে কাফিরদের উপমা এমন এক রাখালের মতো, যে তার ভেড়াদের ডাকে; কিন্তু তারা কেবল তার আওয়াজ শোনে, অর্থ বোঝে না।’ (বাগাভি, মাআলিমুত তানযিল, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৭)
সাইয়্যেদ কুতুব তাঁর তাফসিরে বলেন, ‘এটি অন্ধ অনুকরণ ও জড়তার একটি জীবন্ত চিত্র। এটি এমন একটি পশুর মতো, যে রাখালের ডাক শোনে, কিন্তু তার অর্থ বোঝে না। বরং এরা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ পশু দেখে, শোনে, ডাকে কিন্তু এরা বধির, মূক ও অন্ধ।’ (কুতুব, ফি যিলালিল কুরআন, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১৫)।
এই আয়াতে অন্ধ অনুকরণকারীদের তুলনা করা হয়েছে এমন পশুর সঙ্গে, যারা শুধু আওয়াজ শোনে; কিন্তু তা বোঝে না। তাদের কান, চোখ ও জিহ্বা থাকলেও যেহেতু তারা তা দিয়ে হিদায়াত গ্রহণ করে না, তাই তা অকেজো। তাদের একমাত্র অজুহাত, ‘আমরা তা–ই অনুসরণ করব, যার উপর আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি।’
এই অন্ধতা তাদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট করে।
রাসুল (সা.) তাঁর সম্প্রদায়কে সত্যের পথে আহ্বান করেছিলেন; কিন্তু তারা পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত পথ অনুসরণ করেছিল। আজও আমাদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের বুদ্ধি ও হৃদয় খোলা রাখতে হবে, যাতে আমরা