সারাদেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু, একইসঙ্গে করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টর সংক্রমণ বাড়ায এ রোগ নিয়েও বাড়ছে আতঙ্ক। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিগত বছরের তুলনায় এবছর মৃত্যুর হার কিছুটা কম হলেও আক্রান্ত অনেক বেশি। ফলে এ বছর পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুমের প্রতিবছর জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মশার সংখ্যা বেড়ে যায়। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও সেপ্টেম্বর-আগস্টে ডেঙ্গু ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করতে পারে। এছাড়াও এবছর থেমে থেমে বৃষ্টি, সাথে ভ্যাবসা গরমে ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এদিকে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৯ হাজার ৪৮৪ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১ দশমিক ১ শতাংশ নারী। চলতি বছর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন মোট ৮ হাজার ৩৮০ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪১ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মারা গেছেন ৫৭৫ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে এডিস মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শুধু প্রশাসন নয়, নাগরিকদেরও সচেতনতা জরুরি। নিজের বাসা ও আশপাশে দুদিনের বেশি পানি জমতে না দেওয়া এবং ঘুমানোর সময় মশারি টাঙানো আবশ্যক। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু,গর্ভবর্তী নারী, নানা জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম সবচেয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন তারা। তাই জ্বর এলে কোনভাবেই অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু আবারও বড় হুমকির রূপ নিচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ আবেদ খান বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। আগের বছরগুলোতে মূলত ঢাকা শহরে ডেঙ্গু বেশি দেখা গেলেও বর্তমানে তা ছড়িয়ে পড়েছে বরিশাল, বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এবার তিনটি ভিন্ন সেরোটাইপ (DEN-1, DEN-2, DEN-3) দ্বারা সংক্রমণ হচ্ছে বলে জানা গেছে, যা রোগীদের জটিলতায় ফেলছে।
চলতি সময়ের ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেন-১, ডেন-২ এবং ডেন-৩ সেরোটাইপ সক্রিয় পাওয়া গেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশা নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ বলেও উল্লেখ করেন ডাঃ আবেদ খান।
তিনি আরও বলেন, আগে এটি ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও এখন সারাদেশেই ডেঙ্গুর বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া ১৬–২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেও সংক্রমণের হার বাড়ছে, যা অতীতে তুলনামূলক কম ছিল।
ডেঙ্গু সংক্রান্ত বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মো. নাজমুল হাসান। তিনি জানান, ডেঙ্গু জ্বর এর হালকা উপসর্গে (যেমন: ৩-৫ দিন জ্বর, মাথাব্যথা, হালকা গায়ে ব্যথা) রোগীকে বাড়িতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল পানীয় (স্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ) গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য কেবল প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যাবে (২৪ ঘণ্টায় ৩ গ্রাম এর বেশি না)। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন বা ব্যাথানাশক জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ। কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। জ্বর কমে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়া, বারবার বমি, পেটব্যথা, রক্তপাত, ঘন ঘন দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট বা মলিন চামড়া, অস্থিরতা, অজ্ঞানভাব, মাথা ঘুরানো – এই উপসর্গ দেখা গেলে গর্ভবতী নারীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্টেরয়েড (যেমন ডেক্সামেথাসন, হাইড্রোকরটিসন) ব্যবহার রোগীর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, ফুসফুসে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় প্রমাণিত, এতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কোনো উপকার হয় না। অল্প কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে স্টেরয়েড ব্যবহার করা যাবে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারেরও প্রয়োজন নেই, কারণ ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। শুধুমাত্র যদি নিশ্চিত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ থাকে (যেমন নিউমোনিয়া), তখন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অকার্যকর ও বিপজ্জনক।
সম্প্রতি অনেকেই ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেট বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় হিসেবে পেঁপে পাতার রস ও অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করছেন বলে উল্লেখ করেন ডাঃ মো. নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মতে, পেঁপে পাতার রসে প্লাটিলেট বাড়ানোর বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। এছাড়াও ভুল মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, পেটব্যথা ও লিভারের সমস্যাও হতে পারে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় এটি কোনো বিকল্প নয়। বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল খাবার গ্রহণ এবং সময়মতো হাসপাতালে যাওয়াই এখনো সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
এদিকে ডেঙ্গুর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনাও। কোভিড-১৯ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা তিন ডোজ টিকা নিয়েছেন, তারা তীব্র কোভিডের ঝুঁকি থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত। তবে নতুন ভ্যারিয়েন্টে সাধারণ ফ্লু ও কোভিড একসঙ্গে সংক্রমিত হচ্ছে, যা বর্তমানে ‘ফ্লুরোনা’ নামে পরিচিত। এতে করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, যেমন—ডায়াবেটিস, স্থূলতা, ক্যান্সার বা কিডনি রোগে আক্রান্ত—তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার নতুন ধরন প্রতিরোধে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মাস্ক পরা, বাহির থেকে ঘরে এলে হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি অপসারণ, ফুলের টব বা খোলা পাত্র ঢেকে রাখা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয়েও সচেতন হতে হবে। সরকার এককভাবে এসব রোগ প্রতিরোধ করতে পারবে না যদি না জনগণ নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করে। বিশেষ করে স্কুল, অফিস ও গণপরিবহনে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
দেশে করোনার সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে এ রোগে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সচেতন না হলে আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘জনসচেতনতার বিকল্প নেই। সবাইকে আগের মতোই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সেইসঙ্গে সরকারের উচিত জনসাধারণকে নিয়মিতভাবে করোনার আপডেট জানানো। তাহলে মানুষও বুঝতে পারে, কতটা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা। মানুষেরও চলাফেরায় পরিবর্তন আসবে।’
এ বিষয়ে অধ্যাপক ডাঃ লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও আগের মতো ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হবে না। বর্তমান ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ায়, তবে ব্যাপকহারে প্রাণঘাতী নয়। সচেতনতাই অনেক কিছু বদলে দেবে। লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করা যাবে না, করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করাতে হবে।’
করোনা ও ডেঙ্গুর বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ মো. শাহিনুল আলম বলেন, করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। আর ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে হবে ইভিডেন্স বেইসড মেডিসিনের ওপর ভিত্তি করে, গাইডলাইন অনুসরণ করে। যদি গাইডলাইন অনুসারে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় তাহলে রোগী যেমন সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পাবেন, আবার চিকিৎসা ব্যয়ও কমে আসবে। একই সঙ্গে এটি রোগীর আরোগ্য লাভে ও জীবন বাঁচাতেও বিরাট ভূমিকা রাখবে।