সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: দুখু মিয়া ছিলেন একাধারে বিদ্রোহী কবি, তিনি প্রেমের কবি, তিনি শোষিতের কবি। নজরুলের বিশ্বাসের গভীরে ছিল ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান’ আর সে কারণেই তিনি মানুষের বিভেদ সৃষ্টিকারী দেয়ালগুলো ভাঙতে চেয়েছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জনগ্রহণ করেছি, এর অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নজরুল তূর্যবাদকদের একজন নন তিনি ছিলেন সেই তূর্যবাদক দলের নায়ক। বিশ্ব চেতনার ধারক অন্যতম এক বাঙালি ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি তার কবিতা ও গান দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন বাঙালিকে। কখনো গায়ক, কখনো নায়ক আবার কখনো অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকার মাধ্যমে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আবির্ভূত হয়েছিলেন এই পৃথিবীতে। দুখু মিয়া চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আবৃত্তিকার, গায়ক, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও সংগঠক হিসেবে জড়িত ছিলেন ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত। কবি নজরুল কখনো মসজিদের ইমাম হয়ে জানান দিলেন ইসলামের আদর্শ পথ চলার দিকনির্দেশনা। আল্লাহরা পথে আত্মসমর্পণ-রচনায় নজর“ল জানিয়েছেন, ‘ইন্না সালাতি ও নুসুকি ওয়া মাহয়্যায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহো রাব্বিল আলামিন’-আমার সব প্রার্থনা নামাজ-রোজা, তপস্যা, জীবন-মরণ সবকিছু বিশ্বের একমাত্র পরম প্রভু আল্লাহর পবিত্র নামে নিবেদিত। একটি চিঠিতে নজর“লের আধ্যাত্মজীবনের পরিচয় রয়েছে ‘আমার মন্ত্র’ ইয়াকা না বুদু ওয়া ইয়াকা নাস্তাইন। কেবল এক আল্লাহরা আমি দাস, অন্য কারোর দাসত্ব আমি স্বীকার করি না। একমাত্র তাঁর কাছে শক্তি ভিক্ষা করি (নজরুল রচনা সম্ভার, পৃষ্ঠা-৪৭৪)। সাহিত্যাকাশে হঠাৎ করেই বাইশ-তেইশ বছরের এক অর্বাচীন যুবকের উদয় হলো। সে বঙ্গবাসী হতদরিদ্র, নির্যাতিত মানুষকে যা দিয়েছিল আর কখনো কেউ সেভাবে দিতে পারবে না। এমন আলোই উদ্ভাসিত করেছিল সেই অর্বাচীন যুবক যা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর কবিতার আবৃত্তিতে গায়ের লোম শিউরে ওঠে না এমন বাঙালি পাওয়া ভার। হ্যাঁ সেই অর্বাচীন যুবকই হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
১৮৯৯ সালের ২৫ মে বর্ধমান জেলার চুর“লিয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত কাজী বংশে জন্মগ্রহণ করেন বিদ্রোহী, প্রেম আর শোষিতের কবি । স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম কাজী ফকির আহমেদ ও জাহিদা খাতুনের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন দুখু মিয়া। কাজী নজরুল ইসলামের দুই ভাই-কাজী সাহিবজান, কাজী আলী হুসেইন এবং একমাত্র বোন ছিলেন উম্মে কুলসুম। বাবা কাজী ফকির আহমেদকে বাল্যকালে হারান কাজী নজরুল। আসানসোলের চা-রুটির পদাকানে রুটির কাজ করার সময় সেখানে কর্মরত দারোগা রফিজ উল্লাহরা সঙ্গে পরিচয় হয় নজর“লের। তিনি কিশোর নজর“ল নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। এটা ১৯১৪ সালের কথা। মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন নজরুল ইসলাম। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। এভাবে দুখু মিয়া জীবনসংগ্রামে যুক্ত হন। সময়টি ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি, বাংলা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ, সাপ্তাহিক ‘বিজলী পত্রিকায়’ প্রথমবারের মতো নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পাঠক মহলে এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে হলো একই সপ্তাহে। তার বাসনা ছিল সর্বদাই মানুষে মানুষে বিভেদ দূর করে এমন একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যে সমাজ সব জাত-পাতের ঊর্ধ্বে থাকবে। তাই তো ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি তার সেই চিরš—ন বাসনার কথা বলেছেন এভাবেই: ‘গাহি সাম্যের গান-/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/ নাই দেশ-কাল পাত্রভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি’/ এই যে একটি চিরসত্য কথা নজরুল অবলীলায় বলেছেন, ‘অভেদ ধর্ম জাতি।’ নজরুলকে বোঝা বা তার মনের বাসনা বোঝা খুব সহজ কথা নয়। তবুও তার লেখার যে কয়েকটি স্থানে তিনি তার বাসনার ইঙ্গিত দিয়েছেন তার মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ ও ‘মানুষ’ কবিতা দুটি উলেখযোগ্য। নজরুল ন্যায়, সত্যের পক্ষে অন্যায় ও অসত্যের বিপক্ষে অন্যভাবে দেখলে তার আদর্শ ও দর্শনের সাথে প্রতারণা করা হবে। ‘মানুষ’ কবিতায় নজররুল বলেছেনঃ ‘আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহীম মহাম্মদ/ কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর, -বিশ্বের সম্পদ।’ তিনি কখনো কাউকেই ছোট করে দেখেননি। তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় সবচেয়ে গুর“ত্ব পেয়েছে : মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি/ সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’’ এখানে নজর“লের এক বিশাল বাসনা প্রকাশ পেয়েছে। সমাজ হতে ধর্মীয় দ্বন্ধ কুসংস্কার দূর করে নতুন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যা হবে সাম্যর ভিত্তিতে। নজর“ল স্পষ্টতই বুঝেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাই আসলে ব্রিটিশদের এ দেশে থাকার একটি বড় হাতিয়ার। সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধিয়ে ইংরেজরা সব সময় এ উপমহাদেশে তাদের শাসন বলবৎ রেখেছে। যার মূলে এদেশের ধর্ম বোদ্ধাদের অজ্ঞতা। তাই ‘মানুষ’ কবিতায় দুই ধর্মের বোদ্ধাদের উদ্দেশ্যই নজর“ল বলেছেনঃ ‘তব মসজিদ মন্দিরে প্রভুু নাই মানুষের দাবি,/ মোলা পুর“ত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’ এরপর মসজিদ আর মন্দিরে যে রামরাজত্ব ধর্মবোদ্ধারা কায়েম করেছিলেন, তার বির“দ্ধে বজ্র্র হুংকার দিয়ে নজর“ল তাদেরকে এই বলেছেন : ‘হায় রে ভজনালয়,/ তোমার মিনারে চড়িয়া ভক্ত গাহে স্বার্থের জয়।’ এই যে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ এর মূলে ছিল মোল্যা আর পুরোহিত যাদের পেট চলত মসজিদ-মন্দির হতে প্রাপ্ত আয়ে। এরাই ব্রিটিশদের কাছে টাকা খেয়ে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুশাসনের অপব্যাখ্যা করে হিন্দু-মুসলমানদের সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টাই লিপ্ত থাকত। নজর“ল কিভাবেই বা শান্ত হবেন! তিনি যে ‘বিদ্রোহী’র মাধ্যমেই জানিয়ে দিলেনঃ ‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে নাথ/ বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত।’ কবি এভাবে নিজেকে এবং তাঁর লেখনীকে কোন স¤প্রদায়, জাতি, গোষ্ঠী, দল, দেশ, ধর্ম কোনকিছুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। আর তাই তিনি হয়ে উঠেছেন সকল কালের, সকল জাতির, সকল দেশের, সকল মানুষের সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বের। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে উদার ও অসা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারী নজর“ল হয়েছিলেন সকল শ্রেণী ও জাতির মিলন দূত। আর তাই তো কবি অন্নদা শংকর রায় নজর“লকে নিয়ে লিখেছেন- ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সব কিছু/ভাগ হয়ে গেছে/শুধু ভাগ হয়নি কো/ নজর“ল।’ বিদ্রোহী কবি’র বৈশিষ্ট্য তিনি রাজনীতিবিদ, মানবপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক, শি¶ানুরাগী, অসা¤প্রদায়িক ভারতবর্ষের রূপকার। তাঁর কবিতা ও গান হৃদয় অনুরণনের ও মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের। তাঁর কবিতা ও গান বিদ্রোহের। তাঁর কবিতা ও গান অসাম্প্রদায়িকতার। তাঁর কবিতা ও গান পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার। তাঁর কবিতা ও গান স্বাধীনতার। তাঁর কবিতা ও গান মুক্তির। তাঁর কবিতা ও গান মনুষ্যত্ব বোধের। তাঁর কবিতা ও গান বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ও বিশ্বের সকল সুন্দরের, সকল মানুষের। তিনি লিখেছেন-“ মোরা একই বৃত্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান।”/ “বদনা গাড়–তে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই।/ মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাশ নাই।” সকল মানুষকে শুধু মানুষ পরিচয়ে তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন: ‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/ এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশী।’ কোলকাতায় পারিবারিক তত্ত¡াবধানে থাকা বাকরুদ্ধ এ কবিকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন জাতির জনক ও বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাখা হয় নজর“ল ইসলামকে। অভিসিক্ত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়। চিরবিদ্রোহী এ কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ‘আজান’ কবিতায় চাওয়া শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয় চির জাগরণের এ কবিকে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন। ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার চেতনাকে কাজে লাগিয়ে সকল অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে দেশ ও জাতি, থাকবেনা কোনো বিবেধ, হানাহানি-এটাই আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
আখতার-উজ-জামান
লেখক, গবেষক, সাংবাদিক
e-mail: azamanrahat@gmail.com