রাজধানীতে বিক্ষোভ ও দাবিসংবলিত আন্দোলন কর্মসূচির প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে রাজধানীবাসীর জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১৫ মে) দিনভর রাজধানীর তিন স্থানে আন্দোলন হয়েছে।
আন্দোলনের ফলে অ্যাম্বুলেন্স সহ জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া পরিবহন, কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়া, কিংবা স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে সীমাহীন ভোগান্তি। অনেক এলাকায় দেখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন একটুও না নড়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তায় বাস, প্রাইভেট কার, রিকশা আর মোটরসাইকেলের দীর্ঘ সারি যেন এক স্থবির শহরের চিত্র এঁকে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যেই ভোগান্তির চিত্র ভাইরাল হয়েছে, জনমনে তৈরি হয়েছে হতাশা ও ক্ষোভ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই শুরু হয় একের পর এক আন্দোলন। এতে এক রকম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বর্তমান সরকার। এসব আন্দোলনের মধ্যে ৭৬ শতাংশই হয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবীর ব্যানারে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের সংখ্যা ৩২ শতাংশ।
এছাড়া শ্রমিক আন্দোলন ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ব্যানারের আন্দোলন ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ আন্দোলন ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ১০ শতাংশ আন্দোলন এখনো চলমান।
এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গত আট মাসে যেসব দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-চাকরিচ্যুতি ও পুনর্বহালের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার, শহিদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত, সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন দাবি, শ্রমিক স্বার্থ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আন্দোলন, পরিবহন ও যানবাহনসংক্রান্ত, অটোরিকশাসংশ্লিষ্টসহ আরও অনেক দাবি।
পথচারীরা বলছেন, যে কোনো সংগঠন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দাবি জানাতেই পারে। তবে কয়েক মাস ধরে যে প্রক্রিয়ায় দাবি জানানো হচ্ছে, সেটা যথাযথ নয়। কিছু হলেই আন্দোলন শুরু হচ্ছে, দখল করা হচ্ছে রাজপথ। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।
এদিকে বুধবার (১৪ মে) ডিপ্লোমা নার্সদের ডিগ্রির স্বীকৃতির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ এবং আবাসন-ভাতার দাবিতে কাকরাইল মোড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে অচল হয়ে পড়ে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়ক। এতে রাজধানীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তীব্র যানজট, বৃষ্টির কারণে দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিনকার কাজে বের হওয়া সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় সীমাহীন ভোগান্তিতে।
বুধবার দুপুর ২টার কিছু পরে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে ডিপ্লোমা নার্সিং শিক্ষার্থীরা। একই সময়ে কাকরাইল মোড় অবরোধ করে ‘লং মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচিতে অংশ নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতেও গুলিস্তানে অবস্থান নেয় আরেকদল বিক্ষোভকারী। ফলে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ সময় ধরে যানজট।
ডিপ্লোমা নার্সিং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে আগত রোগীদের ভোগান্তি ছিল চরমে। এসময় সাত মাসের এক শিশুকে নিয়ে বিপাকে পড়েন এক বাবা। তিনি আন্দোলনকারীদের বারবার অনুরোধ করেন যেন তার গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, শাহবাগ, কাকরাইল, গুলিস্তান, ফার্মগেট, মালিবাগ, মগবাজার, তেজগাঁওসহ বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থবির হয়ে পড়ে যান চলাচল। বাস, সিএনজি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত গাড়িও দীর্ঘ সময় আটকে থাকে সড়কে। অনেকে বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সামনে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীরা বৃহস্পতিবার সকালেও অবরোধ অব্যাহত রাখেন। অফিস সময়ে বাড়তি চাপের মধ্যে এসব সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ বহুগুণে বেড়ে যায়।
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে থাকা পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত দুটি পয়েন্ট-কাকরাইল ও শাহবাগে একাধিক ঘণ্টা ধরে যান চলাচল বন্ধ। ডাইভারশন দেওয়া হয়েছে, বিকল্প সড়ক ব্যবহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা রাস্তা ছাড়ছেন না।
তারা আরও জানান, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা চলছে। তবে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়ছে, যা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা তৈরি করছে।
বুধবার কাকরাইল মসজিদের সামনে পুলিশি বাধা অতিক্রম করে যমুনার দিকে অগ্রসর হতে গেলে জবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হন, যাদের মধ্যে শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী রয়েছেন।
জবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. রইস উদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা সড়কে থাকব।’
বাসচালক, যাত্রী, মোটরসাইকেল আরোহী থেকে শুরু করে সিএনজি চালকরা প্রশ্ন তুলছেন-প্রতিদিন সড়কে আন্দোলন চলবে আর জনগণ কষ্ট করবে, এটি কি কোনো সমাধান?
আন্দোলনকারীরা বলছেন, দাবিগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে, আর প্রশাসনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এই অচলাবস্থার অবসান না হলে আগামী দিনগুলোতে নাগরিক জীবনে দুর্ভোগ আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের ১৩ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে পালিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আন্দোলনের সংখ্যা কিছুটা কমে। একই মাসের ১০ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে আন্দোলন চালায় সরকারি চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীরা। অক্টোবর মাসে ফের আন্দোলনের চাপ বাড়ে। পুরো মাসব্যাপী আন্দোলন চালায় সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। নভেম্বর মাসে আন্দোলন কিছুটা হ্রাস পেলেও ৭ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত কিছু বড় কর্মসূচি ছিল।
গত ডিসেম্বরে তিতুমীর কলেজ ও শিক্ষক সংগঠনের আন্দোলনে উত্তাল ছিল রাজপথ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আবারও আন্দোলনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২৫ থেকে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে অনেকগুলো কর্মসূচি চোখে পড়ে। ফেব্রুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির মাধ্যমে সরকারকে বড় ধাক্কা দিতে চেয়েছিল একটি পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি। চলতি মাসের শুরু থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন-হয়রানি এবং ধর্ষণের বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে।
এসবের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আন্দোলন চলছে। এছাড়া বনানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় পোশাক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় সড়ক অবরোধে সোমবার অচল হয়ে পড়ে পুরো রাজধানী।
চাকরি পুনর্বহালের আন্দোলনের মধ্যে আছে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য, সেনা সদস্য ও বিজিবি ৭৬তম ব্যাচ, ব্যাটালিয়ন আনসার ও সাধারণ আনসার, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গ্রামীণফোন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন।
সরকারি চাকরিজীবী আন্দোলনসংক্রান্ত দাবির মধ্যে আছে-চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর, ১১-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য নিরসন ও পদোন্নতি, উপসচিব পদে ক্যাডারদের সমান সুযোগের দাবি এবং কর্মকর্তাদের বদলি নীতি সংস্কার।
শ্রমিক আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে আছে-নির্মাণ শ্রমিকের নিরাপত্তা, বাসস্থান ও রেশনিং ব্যবস্থা চালু; রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিকদের লাইসেন্স ও রুট পারমিট এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে আছে-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসন ও চাকরি স্থায়ীকরণ, মেডিকেল টেকনোলজি ও ফার্মেসি শিক্ষার্থীদের বৈষম্য দূরীকরণ, ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি এবং শিক্ষার কারিকুলাম পরিবর্তন।
সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠনসংক্রান্ত আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, হিন্দুধর্মীয় গুরু চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ মঞ্চের এবং বৈষম্য দূরীকরণের দাবি ইসকন ও সনাতন ধর্মীয় সংগঠনগুলোর। পরিবহন ও যানবাহনসংক্রান্ত আন্দোলনের দাবির মধ্যে আছে-ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালু রাখা, হালকা মোটরযান চালকদের জন্য সাদা প্লেট সংযুক্ত গাড়ি ভাড়ায় চালানোর অনুমতির দাবি এবং সিএনজিচালকদের রেজিস্ট্রেশন ও পুলিশের হয়রানি বন্ধের দাবি।