সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের জন্যে ,সাজার পরে পুরো পৃথিবীই জেল হয়ে উঠে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিনেমা হয়েছে অনেক। যারা দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে, জেল খাটার পরে আর জেলের বাইরের দুনিয়ায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি, সমাজের এক দ্বিচারিতার কারণে। কেউ বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছামৃত্যু, কেউ ফিরে গেছেন আবার অপরাধের দুনিয়ায় পাপী নয়, পাপকে ঘৃণা করো – এ কথা কেবল মুখে বললেও অন্য সব উপদেশমূলক বাক্যের মত এই বাক্যটিও কেবল থেকে যায় মুখে মুখেই।
হিরোবেসড সিনেমা নির্মাণের বাইরে – বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের মাঝে গল্পভিত্তিক সিনেমা নির্মাণের যে জোয়ার তৈরী হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় শিহাব শাহীন নির্মাণ করেছেন ‘দাগী’।গত ঈদে দাগী সিনেমা হলে মুক্তি পেলেও, এবার ঈদে মুক্তি পেয়েছে জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে। যার দরুণ এই চলচ্চিত্র এসেছে আবার আলোচনায়। মূল চরিত্রের আফরান নিশো ছিলেন, আকস্মাৎ এক খুনের দায়ে যাকে জেলে যেতে হয়, সাজা হয় ১৪ বছরের। জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়েই আবর্তিত হয় এই গল্প। শিহাব শাহীন এর আগে মিষ্টি ভালোবাসা নিয়ে সিনেমা নির্মাণের জন্য পরিচিত থাকলেও, ওটিটির মাধ্যমে বদলে ফেলেছেন পুরোটাই। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ থেকে ‘দাগী এর মাঝে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বদলে ফেলেছেন পুরোটাই। পরিচালনার পাশাপাশী দাগী সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি।
১৫ বছরের দীর্ঘ কারাবাসের পর সিনেমার মূল চরিত্রে থাকা নিশান অবশেষে মুক্তি পেলেও, তার মুক্তি যেন শুধু চার দেওয়ালের গণ্ডি ছাড়িয়ে আসা নয়- এটা ছিল এক নতুন সংগ্রামের শুরু। বাইরের জগৎ বদলে গেছে, সময় চলেছে নিজের গতিতে, কিন্তু নিশান যেন বারবার ফিরে যায় তার ফেলে আছে সেই পুরনো ঘূর্ণিপাকে, যেখানে তার ফেলে আসা জীবন এখনো তাকে গিলে ফেলতে চায়। মূলত মানুষের মনে থাকা এই দ্বিচারিতাই গল্পের আসল শক্তি – যাকে মানবিক দ্বন্দ্ব হিসেবেই বলা যায় ।
এক সময়ের চোরাচালান চক্রের অংশীদার নিশান এখন নতুন এক জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সে যতই সামনে এগোতে চায়, অতীতের ছায়া ততই দীর্ঘ হয়। হঠাৎ করেই তার সামনে হাজির হয় এক পুরোনো সঙ্গী , যে তাকে আবার ডেকে নিয়ে যেতে চায় সেই অন্ধকার পথে, যেখানে এক সময় নিশান নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। এই মুহূর্তেই শুরু হয় এক অনিবার্য দ্বন্দ্ব, নতুন জীবনের আলোর আহ্বান, আর পুরোনো জীবনের অন্ধকার টান।
এরই মাঝে নিশানের তৈরি হয় নতুন সম্পর্ক , নতুন সম্পর্ক তাকে আবার ভালোবাসতে শেখায়, কিন্তু তার ভালো হওয়ার পথে আবার কিছু পুরোনো ক্ষত তার মনকে রক্তাক্ত করে তোলে। বিষিয়ে তুললে থাকে পুরোনো ঘা।
এই যাত্রা শুধুই বাহ্যিক নয়, এটি আত্মার গভীরে ডুবে যাওয়ার এক সফর- নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, ক্ষমা পাওয়ার, আর অতীতকে মেনে নেওয়ার সাহস অর্জনের। কিন্তু নিশানের মনে প্রশ্ন জেগে থাকে- কিছু ভুল কি শুধরে নেওয়া যায়? নাকি কিছু পাপের দাগ সত্যিই নিজের শরীর থেকে কখনো মুছে না? যে দাগ সে নিজে দেখে না, দেখে সমাজ!
চাকচিক্য ও জৌলুশবিহীন এই সিনেমার মূল উপজীব্য ছিলো অভিনয় ও গল্প- যার উপরে ভিত্তি করেই এগিয়ে গিয়েছে। সিনেমার গল্প নিশান তথা আফরান নিশোকে ঘিরে আবর্তিত হলেও মোটা দাগে ‘দাগী’ কেবল একক কোন অভিনেতার সিনেমা না। তমা মির্জা, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত থেকে শুরু করে সুনেরাহ- সবাই গল্পে তাদের ভূমিকা যথার্থভাবেই রাখার চেষ্টা করেছেন। গল্পে ছোট কিন্ত অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে মনোজ প্রামাণিক অভিনয় করলেও তার রেশ যেনও ছিলো পুরো চলচ্চিত্র জুড়েই। একটি চরিত্রে মনোজ প্রামাণিক অভিনয় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল ক্যাপ্টিভেটিং, গানের ব্যবহার যথাযথ, সিনেমাটোগ্রাফিও চোখে লেগে থাকার মতো।তবে সিনেমার কিছু অ্যাকশন দৃশ্য যেনও এই সিনেমাকে কিছুটা দুর্বল করে দিয়েছে বলে মনে হয়েছে ।
এটি শুধু একজন অপরাধীর গল্প নয়- এটি একজন অপরাধীর ভেতরে থাকা নিষ্পাপ কিংবা সুন্দরের দিকে ফিরে আসতে চাওয়া লড়াইয়ের, পাপ থেকে মুক্তির জন্য নিরন্তর ছটফটানির, এবং নিজেকে পুনরায় গড়ে তোলার এক করুণ ও গভীর মানবিক উপাখ্যান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এই সিনেমা আমাদের এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়:
“সব পাপ কি ক্ষমার যোগ্য?”
“কিছু ভুল কি শুধরে নেওয়া যায়, নাকি কিছু দাগ কখনোই মুছে না?”
“একজন মানুষ যদি সংশোধনের চেষ্টা করে, তবে তাকে সেই সুযোগ কি আমরা দিই?”
‘দাগী’ সেই নৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক রূপরেখাগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলে যেগুলো আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। এই সিনেমা একটি গল্প না, এটি এক উপলব্ধি- একজন মানুষ কতটা ভেঙে পড়ে আবার গড়ে উঠতে পারে, আর সমাজ তাকে কি আদৌ সেই সুযোগটা দেয়? লেখকঃ শফিকুল সাজীব