নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি নতুন রূপরেখা প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় নতুন প্রস্তাবটি আনা হয়। তবে এটি নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ও জরুরি অবস্থা জারির বিধান নিয়ে আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি। এগুলো নিয়ে আরও আলোচনা হবে।
দলগুলোর সঙ্গে আগের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল তিনটি বিষয়ে সংশোধিত প্রস্তাব হাজির করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রস্তাবটি ছিল নতুন।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল ছিল দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার একাদশ দিন। এই পর্বে ৩০টি রাজনৈতিক দল আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। আগামী রোববার আবার আলোচনা শুরু হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব করেছিল। তবে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এনসিসির প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়। এর ফলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার রূপরেখার সুপারিশও বাদ হয়ে যায়। ২ জুলাই ঐকমত্য কমিশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে সংবিধানে আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান ছিল, তা এবং আরও দু-একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। সেদিন বিচার বিভাগ এবং রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে না রাখার বিষয়ে বেশির ভাগ দল মত দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঐকমত্য কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন নিয়ে নতুন প্রস্তাব উপস্থাপন করে।
প্রস্তাবে বলা হয়, যদি সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়, তাহলে উচ্চকক্ষের চেয়ারম্যান/স্পিকার, ডেপুটি চেয়ারম্যান/ডেপুটি স্পিকার, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, সংখ্যালঘু দলের নেতা, উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বকারী অন্য দলগুলোর একজন প্রতিনিধি, নিম্নকক্ষের স্পিকার, সংসদ নেতা এবং নিম্নকক্ষের বিরোধী দলের নেতার সমন্বয়ে একটি ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন’বিষয়ক সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা হবে। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার ৯০ দিন আগে এ কমিটি গঠন করা হবে।
উচ্চকক্ষের চেয়ারম্যান/স্পিকার অথবা প্যানেল সভাপতির মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনি সর্বদলীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটির সভাপতি উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য নাম চাইবেন। এই পদ্ধতিতে পাওয়া নামগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার পর কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের জন্য একজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিয়োগ দেবেন।
এরপর প্রধান উপদেষ্টা সমাজের নির্দলীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ১৫ জনের নাম উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন।
প্রস্তাবে বলা হয়, সর্বদলীয় কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কারও নাম চূড়ান্ত করতে না পারলে উচ্চকক্ষের স্পিকার উচ্চকক্ষের বৈঠক ডাকবেন। তাতে উচ্চকক্ষের সদস্যরা ‘র্যাঙ্কড চয়েজ’ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে একজনকে ঠিক করবেন।
প্রস্তাবে বলা হয়, সংসদ ভেঙে যাওয়ার অন্তত ১৫ দিন আগে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন। সংসদ ভেঙে যাওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ৯০/১২০ দিনের জন্য শপথ গ্রহণ করে কার্যভার গ্রহণ করবেন।
ঐকমত্য কমিশনের আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর বা সংসদের মেয়াদ শেষ হলে যে তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করবেন, সেই তারিখ থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে।
গতকাল এই প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। কয়েকটি দলের প্রতিনিধি বৈঠকে বলেন, প্রস্তাবটি আলোচনার মধ্যে তাদের দেওয়া হয়েছে। এটি নিয়ে দলে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন, এ জন্য সময় দরকার।
আলোচনা শেষে বিকেলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা যত দূর সম্ভব ত্রুটিহীন হয় এবং যে ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এই বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
জরুরি অবস্থা জারির বিধান
বিদ্যমান সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বিধান পরিবর্তন করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। গত সোমবার ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় একটি নতুন বিধান প্রস্তাব করা হয়েছিল। তা নিয়ে সেদিন ঐকমত্য হয়নি। এ নিয়ে গতকাল ঐকমত্য কমিশন একটি সংশোধিত প্রস্তাব আনে। তাতে বলা হয়, মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন। ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে’ জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান বাদ যাবে। জরুরি অবস্থা চলাকালে নাগরিকের দুটি অধিকার স্থগিত করা যাবে না। সে দুটি হলো জীবনের অধিকার এবং নির্যাতন ও নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তি থেকে রক্ষা।
প্রধানমন্ত্রীর বদলে মন্ত্রিসভার অনুমোদনে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন—এই বিধানের সঙ্গে একমত নয় জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। এখনকার সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারির আগে এ ঘোষণার বৈধতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর প্রয়োজন হয়।
গতকালের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা একই বিষয়। তিনি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির পরামর্শে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন—এমন বিধান করার প্রস্তাব করেন।
এনিসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির পরামর্শে জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে তিনি মত দেন।
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির সুপারিশে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করবেন, এমন বিধান করা হলে সর্বদলীয় কমিটির ঐকমত্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হতে পারে।
আলোচনা শেষে বিকেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, এ বিষয়টা আরও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আরও কী কী বিষয় সংযুক্ত করা যায়, সেসব আগামী সপ্তাহের আলোচনায় সুস্পষ্ট হবে।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাব করেছিল বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। আগের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল এ নিয়ে কিছুটা সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপন করে ঐকমত্য কমিশন। তাতে বলা হয়, ‘আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসার্মথ্যের অভিযোগের কারণে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে কোনো তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান না থাকলে, রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন।’
গতকাল একাধিক দল আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে মত দেয়। আবার অনেক দল কমিশনের প্রস্তাবকে সমর্থন করে। তবে শেষ পর্যন্ত এটি নিয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য হয়নি।
আলোচনা শেষে গতকাল বিকেলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এগুলো হলো, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন। তবে প্রধান বিচারপতি হিসেবে কর্মে নিযুক্ত জ্যেষ্ঠতম একজনকে নাকি কর্মে জ্যেষ্ঠ দুজনের মধ্যে একজনকে নিয়োগ করা হবে, সে বিষয়ে দুটি মত আছে। কমিশন এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গতকাল আলোচনায় কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।