অনেকে খুব সহজে বলে ফেলেন, আল্লাহ তো অনেক দয়ালু। আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন, এত চিন্তা কিসের? তারা হাসিমুখে নিশ্চিন্তে গুনাহ করে যান। আবার কিছু মানুষ এও বলে, মানুষ কত কী গুনাহ করে, আমার এসব তো ছোটখাটো গুনাহ। ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলে একসময় মাফ চেয়ে নেব, ব্যস। কেউ ভাবেন, সওয়াবের কাজ করব আবার গুনাহ্ করব একটু। বা গুনাহ করে সওয়াবের কাজ করে ফেলব। কাটাকাটি হয়ে যাবে।
কেউ কেউ উদাহরণ দেন, একজন পতিতা পানি পান করানোর মতো ক্ষুদ্র কাজ করেও জান্নাতে গেছে। অথবা একজন একশোটি খুন করেও ক্ষমা পেয়ে গেছে।
কথা হল, সবার ভাগ্যেই কি এটা ঘটবে? কার ভাগ্যে ক্ষমা জুটবে, কে সৌভাগ্যবান হবে এটা কে বলতে পারে? যারা ক্ষমা পেয়েছেন, হতে পারে তারা না জেনে পাপ করেছিলেন। জানার পরপর ক্ষমা চেয়েছেন এবং এমনভাবে তওবা করেছেন যে দ্বিতীয়বার আর সে পাপ করেননি।
আর যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল।
সুরা ত্বহা, আয়াত: ৮২
জেনেশুনে পাপ করা আর না জেনে পাপ করা কি সমান? তাওবা কবুলের অন্যতম শর্ত হল, এমনভাবে অনুশোচনা করা যে আর কখনো সে পাপ করবে না।
বান্দার মনের গোপন, প্রকাশ্য সব খবর আল্লাহ জানেন । বান্দা কি জেনে বুঝে ইচ্ছে করে গুনাহ করছে, নাকি না জেনে বা ভুলবশত গুনাহ করছে, তা তাঁর অজানা নেই। তাঁকে ফাঁকি দেওয়ার কোন উপায় নেই। তিনি লাতিফুল খবির বা অতি সূক্ষ্মদর্শী।
জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত হয়েও আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) প্রতিদিন সত্তরবারের বেশি ইস্তিগফার করতেন। অথচ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ গুনাহমুক্ত। তাহলে তাঁর উম্মত হয়ে আমরা কিভাবে এত নিশ্চিন্তে গুনাহ করতে পারি? কিভাবে ভাবি, ক্ষমা তো মিলবেই। এত নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় কীভাবে আশা করতে পারি?
হ্যাঁ, আল্লাহ্ অতি দয়ালু, ক্ষমাশীল। আবার অবাধ্যদের শাস্তিদানের বেলায় কিন্তু তিনি অনেক কঠোরও। আল্লাহর ক্ষমার আশা করতে হবে, কিন্তু ভয়ও করতে হবে। বলা হয়েছে, বান্দার গুনাহ আকাশ পরিমাণ হলেও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন।
তবে তার জন্য কোনো গুনাহ করার পর হৃদয়ে অপরাধবোধ জাগ্রত হতে হবে। নিজেকে গুনাহের কারণে অপরাধী মনে করে সেই গুনাহ আর না করার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ফিরে যেতে হবে, তওবা করতে হবে।
তওবা করলেই সেটা কবুল হয়ে যায় না বা মুখে ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারাই আল্লাহ ক্ষমা করে দেন না। তওবা কবুল হওয়া বা শুদ্ধ হওয়ার জন্য একাধিক শর্ত রয়েছে।
আর হৃদয়কে সবধরনের গুনাহ, অন্যায় থেকে বিরত রাখার মাধ্যমেই একজন বান্দা সফলকাম হতে পারে। সুরা ত্বহায় আল্লাহ বলেছেন, “আর যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল।” (সুরা ত্বহা, আয়াত: ৮২)
তবে তওবা কিন্তু মোটেও সহজ নয় যে মুখে বললাম তওবা করেছি, ব্যস হয়ে গেল। কারণ তওবা করলেই সেটা কবুল হয়ে যায় না বা মুখে ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারাই আল্লাহ ক্ষমা করে দেন না। তওবা কবুল হওয়া বা শুদ্ধ হওয়ার জন্য একাধিক শর্ত রয়েছে। শর্তগুলো পূরণ করা তওবা কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। শর্তগুলো হচ্ছে:
কৃত গুনাহের জন্য আন্তরিকভাবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া।
এ ধরনের গুনাহ্ দ্বিতীয়বার না করার উপর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।
আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধচিত্তে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করা।
যদি অন্য কারো উপর জুলুম বা অন্যায় করা হয়ে থাকে তবে ঐ ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়া।
গুনাহ করতে করতে অনেকের এমন অবস্থা হয়, গুনাহকে ঘৃণা করা বা খারাপ মনে করার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। ফলে গুনাহের কাজে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়; তার কাছে যেকোনো গুনাহ তুচ্ছ মনে হয়। অথচ একটি ছোট ছিদ্র যেমন বিশাল জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে পারে, তেমনি একটি ছোট গুনাহও মানুষের ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
এরপর সেই মানুষ আর কোনো কিছুতেই অস্বস্তি বোধ করে না। মানুষজন যদি তাকে গুনাহ করতে দেখে ফেলে বা সমালোচনা করে, তাতেও সে লজ্জাবোধ করে না। বরং গুনাহকে স্বাভাবিক মনে করে, আর অন্যায় ও অবাধ্যতাকে গুরুত্বহীন ভাবতে শুরু করে।
যখন একজন মানুষ গুনাহ করতে করতে গুনাহকে তার কাছে সহজ মনে হয়, গুনাহকে ছোট মনে করে, এবং তার মধ্যে আর কোনো লজ্জা বা অপরাধবোধ কাজ করে না; তখনই তা-ই তার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তবু মানুষ দুনিয়ার মোহে ব্যস্ত। গুনাহ করে, করতেই থাকে। বিশুদ্ধ তওবা করতে দেরি করে। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ তবু বান্দার জন্য দরজা খোলা রাখেন যতক্ষণ প্রাণ গলায় পৌঁছেনি
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, “মুমিন নিজ গুনাহকে এমনভাবে দেখে, যেন একটি পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে আশঙ্কা করছে যে সেটি তার ওপর পতিত হবে আর পাপী নিজ গুনাহসমূহকে মাছির মত মনে করে যা তার নাকের ওপর পড়েছে একটু পর উড়ে গিয়েছে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৪৯)
তবুও দয়াময় আল্লাহর করুণা অপরিসীম। তিনি বান্দাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন এবং চান, মানুষ গুনাহের পরও গুনাহ মুক্তভাবে বিচারদিবসে উপস্থিত হোক। তাই কেউ গুনাহ করলে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে গুনাহ হয়ে গেলেও তার প্রতিকার হিসেবে বিশুদ্ধ চিত্তে ক্ষমা চাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন।
রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পাপ থেকে তওবা করে, সে এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যেন সে কখনো পাপই করেনি।” তিনি আরো বলেছেন, “আদম সন্তানের প্রত্যেকেই ভুলকারী। আর তাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাওবাকারী।” (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৪৯৯)
তবে যারা নিশ্চিন্তে ক্ষমা পাওয়ার আশা নিয়ে গুনাহ করে যেতে থাকে তারা কিভাবে নিশ্চিত থাকে যে তারা ক্ষমা পাবে, বা ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার মতো হায়াত পাবে? যেখানে মৃত্যুর ক্ষেত্রে এক সেকেন্ডেরও ভরসা নেই! কেউ কথা বলতে বলতে, কেউ খেলতে খেলতে, কেউ হাসতে হাসতে মারা যায়। আবার কেউ ঘুমের মাঝেই অদৃশ্য এক যাত্রায় পাড়ি জমায়, ফিরে আসে না। তারা কি জানত, এটাই তাদের শেষ নিঃশ্বাস ছিল? তারা কি ভাবতে পেরেছিল, তাওবা করার আর কোনো সুযোগ তারা পাবে না? মৃত্যু কাউকে সময় দেয় না।
তবু মানুষ দুনিয়ার মোহে ব্যস্ত। গুনাহ করে, করতেই থাকে। বিশুদ্ধ তওবা করতে দেরি করে। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ তবু বান্দার জন্য দরজা খোলা রাখেন যতক্ষণ প্রাণ গলায় পৌঁছেনি, ততক্ষণ ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, বলুন, হে আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন এবং আমাদের তওবা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবা গ্রহণকারী ও পরম দয়ালু।” (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদিস: ৩৮১৪)