যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা মার্কিন ডলার (ইউএসডি) দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে বিবেচিত হলেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এই অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাণিজ্যনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা, ক্রমবর্ধমান জাতীয় ঋণ এবং মার্কিন নেতৃত্বের ভবিষ্যত নিয়ে আস্থার ঘাটতি—এসব কারণে বিনিয়োগকারীদের চোখে ডলারের ঔজ্জ্বল্য অনেকটাই কমে এসেছে।
মঙ্গলবার (২০ মে) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সালে মুডি’স যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং এক ধাপ নামিয়ে দেওয়ার পর থেকে ডলারের ওপর ফের চাপ তৈরি হয়েছে। এই পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের মনে আরও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।
‘আমেরিকা বিক্রি’ বাণিজ্য প্রবণতা ফের জোরালো
বিনিয়োগ সংস্থা কনভেরার প্রধান এফএক্স স্ট্র্যাটেজিস্ট জর্জ ভেসি জানান, মূল্যায়নের দিক থেকে ডলারের আরও পতনের জায়গা রয়েছে।
তিনি বলেন, মুডি’স রেটিং হ্রাসের পর ‘সেল আমেরিকা’ প্রবণতা আবার জেগে উঠেছে।
তিন মাসে ডলার ইনডেক্সে ১০.৬% পতন
চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ডলার ইনডেক্স ইতিমধ্যে ১০.৬% হ্রাস পেয়েছে। এটি ২০২৩ সালের জুলাইয়ের পর থেকে সবচেয়ে নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে, যেখানে সিএফটিসি তথ্য অনুসারে, বিনিয়োগকারীরা ডলারে $১৭.৩২ বিলিয়ন নিট শর্ট পজিশনে আছেন।
জানুয়ারিতে ডলার ইনডেক্স ২০ বছরের গড় (৯০.১) থেকে ২২% বেশি ছিল, যা এখন ১০% উপরে থাকলেও আরও পতনের আশঙ্কা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম দফার সময় দেখা নিম্নস্তরে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।
দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি ও মার্কিন অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতা
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গ্লোবাল জি১০ এফএক্স গবেষণা প্রধান স্টিভ ইংল্যান্ডার বলেন, ডলারের দুর্বলতা এখানেই শেষ নয়।
তিনি জানান, সাম্প্রতিক বাণিজ্য চুক্তি হয়তো বাজারকে কিছুটা স্থিতিশীল করেছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি আস্থার সংকটের সমাধান করেনি।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ট্রাম্পের ব্যাপক কর হ্রাস পরিকল্পনার কারণে আগামী এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ $৩ ট্রিলিয়ন থেকে $৫ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বৈদেশিক বিক্রি ও নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ডলারের পতন
বিএনপি প্যারিবাস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পিটার ভ্যাসালো বলেন, ডলার যদি আর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ না করে, তাহলে এত পরিমাণে ডলার ধরে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
তবে রবেকোর কোলিন গ্রাহাম বলেন, এখনও পর্যন্ত ডলার বা মার্কিন ট্রেজারি বিক্রি করে দেশে ফেরত আনার বড় ধাক্কা দেখা যায়নি, তবে ভবিষ্যতে সেটি ঘটতে পারে।
এশিয়ার বিশাল মার্কিন সম্পদ মজুত ও সম্ভাব্য প্রভাব
চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ান—এসব এশীয় দেশ বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এই দেশগুলোর $২.৫ ট্রিলিয়ন মূল্যের ডলার সঞ্চিত থাকার কারণে ডলারের বিরুদ্ধে তীব্র চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ইউরিজন এসএলজে ক্যাপিটালের স্টিফেন জেন ও জোয়ানা ফ্রেইরে।
ডলারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর
ডলারের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় পাল্টা যুক্তি হলো, এখনও পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে দৃঢ় রয়েছে। ব্র্যান্ডিওয়াইন গ্লোবালের পোর্টফোলিও ম্যানেজার জ্যাক ম্যাকইনটাইর বলেন, মার্কিন ভোক্তারা এখনও খরচ করতে আগ্রহী, যা ডলারের জন্য সাময়িক সহায়ক।
তবে তিনি আরও জানান, আমরা এখন ডলার শক্তিশালী হলে তা বিক্রি করার সুযোগ খুঁজছি, পুনরুদ্ধারে বাজি ধরছি না।
বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। ডলারের পতন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নয়, বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। পরবর্তী কয়েক মাস এই পরিবর্তনশীল চিত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।