মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সম্প্রতি দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যে হামলা চালিয়েছেন, তা ছিল তাঁর ‘ট্রাম্প ডকট্রিন’-এর একটি সফল উদাহরণ।
ভ্যান্সের মতে, এই নীতির মূলকথা হলো—যে সমস্যাটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য হুমকি, তা আগে কূটনৈতিকভাবে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। যদি কূটনীতি কাজ না করে, তাহলে ‘তীব্র সামরিক শক্তি’ ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং তারপর দ্রুত এলাকা ত্যাগ করতে হবে, যাতে তা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে পরিণত না হয়।
কিন্তু বিষয়টা আসলে এত সোজা নয়। ভ্যান্স যেটাকে ‘ডকট্রিন’ বা ‘নীতি’ বলছেন, তা আসলে নতুন কিছু নয়। এটি বরং এমন একধরনের কল্পনাপ্রসূত চিন্তা, যা অতীতে বহু ব্যর্থ, ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘস্থায়ী মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্ম দিয়েছে। ভ্যান্স নিজেও সেসব হস্তক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছেন।যদি ভ্যান্স মনে করেন, এই হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সমস্যাকে ‘সমাধান’ করেছে, তাহলে তার মানে দাঁড়াবে, তিনি বিশ্বাস করেন—এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, ভ্যান্স বিশ্বাস করছেন, ইরানের সেন্ট্রিফিউজ, সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত এবং অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণ সব ধ্বংস হয়ে গেছে। অথবা তিনি হয়তো ভাবছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই শক্তি প্রদর্শন ইরানকে এতটাই ভীত করেছে যে তারা ভবিষ্যতে আর পারমাণবিক কর্মসূচি চালাবে না।
এটা ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে এই হামলা এবং ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা ইরানের পুরো কর্মসূচিকে একেবারে বন্ধ করে দিতে পেরেছে কি না, তা এখনো পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। বরং মনে হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক পরিকল্পনা কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেছে। এই থমকে থাকার সময়সীমা মাস কয়েক থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে।
কিছু দেশ আছে, যারা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতিস্বীকারের ভান করে, কিন্তু কিছুদিন পর আবার আগের আচরণে ফিরে যায়। উত্তর কোরিয়া এমন এক দেশ। তারা বহুবার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির মুখে পিছু হটলেও পরে আবার পারমাণবিক হুমকি দেয়, ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে এবং নানা উসকানিমূলক কাজ করে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে—যতক্ষণ পর্যন্ত এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বা এর সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত ভ্যান্সের বক্তব্য শুধু একটাই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে; আর সেটি হলো, ‘আমেরিকা এখন আবার আগের মতো ভয় দেখাতে পারছে।’
ট্রাম্প প্রশাসনই প্রথম নয়, যারা মনে করেছিল, অল্প সময়ের জন্য শক্তি প্রদর্শন করে অন্য দেশগুলোকে ভয় দেখানো বা যুক্তরাষ্ট্রের কথা মানাতে বাধ্য করা যায়। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন থেকে তারা বহুবার এ ধরনের চেষ্টা করেছে। তবে তার অনেকগুলোই ব্যর্থ হয়েছে।বেশ কয়েকটি দেশের নেতারা যুক্তরাষ্ট্র যতটা আশা করেছিল, তার চেয়েও বেশি কষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন। যেমন ১৯৯০-এর দশকে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন বহুবার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার অস্ত্র পরিদর্শন কার্যক্রমে বাধা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার মুখে পড়েন। এই হামলাগুলো সত্ত্বেও তিনি দমেননি। শেষমেশ ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘শক অ্যান্ড অও’ নামের এক বিশাল সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই অভিযান আট বছরের দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে। এতে কয়েক হাজার মার্কিন সেনা ও প্রায় পাঁচ লাখ ইরাকির মৃত্যু হয়।
একইভাবে ১৯৯০-এর দশকে ন্যাটোও বিভিন্ন হুমকি, অবরোধ ও শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচকে ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও কসোভোয় যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই দমে যাননি। বিশেষ করে কসোভোয় শুরুতে শুধু সামরিক স্থাপনায় সীমাবদ্ধ বিমান হামলা মিলোসেভিচকে থামাতে পারেনি।
এসব উদাহরণ থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যতই শক্তি দেখাক, অনেক সময় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু লাভ হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা সব সময় কার্যকর হয় না। আর কিছু দেশ মার্কিনদের ক্ষতিও করে বসে। যেমন সোমালিয়ার মোহাম্মদ ফারাহ আইদিদ কিছু মার্কিন সেনাকে হত্যা করে দেখিয়েছেন যে শক্তিশালী মার্কিন সেনাও বেকায়দায় পড়লে পিছিয়ে যায়।
ইরান এই তিনটি কৌশলই ব্যবহার করছে। তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক আঘাত সামলাতে পারে। কখনো তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে, কখনো নিজের মতো। ইরান বিশেষজ্ঞ ভালি নাসরের মতে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি একবার বলেছিলেন, ‘আমেরিকা একটা কুকুরের মতো, তুমি যদি পিছিয়ে যাও, ও আক্রমণ করবে; আর তুমি যদি সামনে এগিয়ে যাও, তাহলে ও পিছিয়ে যাবে।’
ভ্যান্স যদি বিশ্বাস করেন, শুধু শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমেই কঠিন রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব (যেমন ইরানকে চিরতরে পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল), তাহলে তা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। কারণ, যদি শুধু ভয় দেখিয়ে এমন লক্ষ্যে পৌঁছানো যেত, তাহলে সেটা সব প্রেসিডেন্টেরই নীতির অংশ হতো।
মেলানি ডব্লিউ সিসন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফরেন পলিসি প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ