মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশিয়া ও চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে ‘সমান তালে’ চলতেই তিনি এমন নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের আগে বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘অন্য দেশগুলোর পরীক্ষামূলক কর্মসূচির কারণে আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছি আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষাও সমানভাবে শুরু করতে।’
তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড়। রাশিয়া দ্বিতীয় অবস্থানে, আর চীন ‘অনেক পিছিয়ে’ তৃতীয় স্থানে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সালের পর থেকে আর কোনো পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালায়নি। তখন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ‘স্নায়ু যুদ্ধ’ অবসানের প্রেক্ষাপটে অস্ত্র পরীক্ষায় স্থগিতাদেশ জারি করেন।
তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পোস্টে বলা হয়, তিনি তার প্রথম মেয়াদেই যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার ‘হালনাগাদ ও আধুনিকায়ন’ করেছেন।
যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, এসব অস্ত্রের ‘অপরিসীম ধ্বংসক্ষমতা’ রয়েছে, তবু ‘কোনো বিকল্প ছিল না’ বলেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে যখন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তখন এ ধরনের পরীক্ষার ঘোষণা সেই প্রতিযোগিতাকে আরও উস্কে দেবে।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এই প্রতিযোগিতাকে ত্বরান্বিত করছে, তবে তারা এটাও বলছেন যে বিশ্ব ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক হুমকির সম্মুখীন।
কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর ফেলো জেমি ওয়াং বলছেন, উত্তর কোরিয়া ছাড়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলো কয়েক দশক ধরে পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়নি, তাই উদ্বেগ রয়েছে যে এই ঘোষণার প্রভাব অন্যদের উপরও পড়বে।
তিনি বলেন, এটি একটি উদ্বেগজনক মুহূর্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন এমন একটি পর্যায়ে প্রবেশ করছে, যা একটি সম্ভাব্য অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
লন্ডন-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক থিংক ট্যাংক ‘রুসি’-এর সিনিয়র ফেলো দারিয়া দোলঝিকোভার মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই বিবৃতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও অনেক কারণ রয়েছে, যা গত কয়েক দশকের তুলনায় পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি এবং পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তারকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
তার মতে, ট্রাম্পের এই ঘোষণা ‘বিশাল এক বালতির মধ্যে এক ফোঁটা জলের মত, এবং এমন অনেক যৌক্তিক উদ্বেগ রয়েছে যে এই বালতি শীঘ্রই উপচে পড়তে পারে’।
বিশেষজ্ঞরা ইউক্রেনের যুদ্ধের মতো ক্রমবর্ধমান সংঘাতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেশ কয়েকবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান ও ভারত, ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই উত্তেজনাগুলো যেকোনো সময় একটি বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
ইসরাইল আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার কথা ঘোষণা বা অস্বীকার করেনি। অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। ইরান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
কোরীয় উপদ্বীপ এবং তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের লক্ষ্য নিয়ে যে উত্তেজনা সেটিও এই পুরো চিত্রটিকে আরো জটিল করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি, যেখানে উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের মোতায়েন সীমিত করতে সম্মত হয়েছিল, তার মেয়াদও আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে যাবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার বিবৃতিতে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। তার এই বক্তব্য স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর তথ্যের সাথে ভিন্ন।
এসআইপিআরআই-এর মতে, রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, যার সংখ্যা ৫,৪৫৯টি। এরপরই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৫,১৭৭টি) এবং চীন (৬০০টি)।
অন্যান্য থিংক ট্যাংকের পরিসংখ্যানও কমবেশি একই রকম।
রাশিয়া সম্প্রতি একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থার পরীক্ষা চালিয়েছে।
ক্রেমলিন বলেছে যে, তাদের একটি ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম এবং অন্যটি সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে মার্কিন উপকূলে পৌঁছাতে পারে।
কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, রাশিয়ার এই পদক্ষেপই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণার কারণ, যদিও রাশিয়া বলেছে যে তাদের পরীক্ষাগুলো ‘পারমাণবিক ছিল না’।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে এবং উদ্বিগ্ন যে, দেশটি পারমাণবিক অস্ত্রের দিক দিয়ে তাদের খুব কাছাকাছি চলে আসতে পারে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘দ্বিপাক্ষিক পারমাণবিক হুমকি’ তৈরি করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় শুরু করা চীন এবং রাশিয়াকেও একই কাজ করতে উৎসাহিত করবে।
মার্কিন ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় চীন বলেছে, তারা আশা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তির অধীনে তার বাধ্যবাধকতা পূরণ করবে এবং পারমাণবিক পরীক্ষা স্থগিত রাখার প্রতিশ্রুতি মেনে চলবে।
ওয়াশিংটনের আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ড্যারিল ক্যাম্পবেল বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা পুনরায় শুরু করা ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার দিক থেকে একটি ঐতিহাসিক ভুল’ হবে।
তিনি বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে, যতক্ষণ না পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিরোধ বা সীমিত করার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, আমরা চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি বিপজ্জনক ত্রি-পক্ষীয় অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা দেখতে পাচ্ছি।
ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্টস-এর পারমাণবিক তথ্য বিষয়ক পরিচালক হ্যান্স ক্রিস্টেনসেন বলছেন, এটি সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বেগজনক, কারণ গত পাঁচ বছরে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ বেড়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ ১৯৯২ সালে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। পরীক্ষাটি নেভাডা অঙ্গরাজ্যে ভূগর্ভে করা হয়েছিল।
বিশ্লেষক ক্যাম্পবেলের মতে, নেভাডার ওই স্থানটিকে পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য পুনরায় প্রস্তুত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ৩৬ মাস সময় লাগবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে তার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য কম্পিউটার সিমুলেশন এবং অন্যান্য অ-বিস্ফোরক পদ্ধতি ব্যবহার করে, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এগুলো বিস্ফোরণ ঘটানোর কোনো বাস্তবসম্মত যুক্তি নেই।
বিশ্লেষক ওয়াং বলছেন, ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষারও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কারণ আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে মাটির উপরে কোনো বিকিরণের প্রভাব না পড়ে বা ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত না হয়।
রক্ষণশীল আমেরিকান থিংক ট্যাংক ‘দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর রিসার্চ ফেলো রবার্ট পিটার্স বলেছেন, যদিও অস্ত্র পরীক্ষার কোনো বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত কারণ নাও থাকতে পারে, তবে এর ‘প্রাথমিক কারণ হলো প্রতিপক্ষকে একটি রাজনৈতিক বার্তা পাঠানো’।
তিনি বলেন, ‘কখনও কখনও একজন প্রেসিডেন্টের তার শক্তি প্রদর্শনের জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা করা প্রয়োজন হতে পারে। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প হোন বা অন্য কেউ।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকা একটি অযৌক্তিক অবস্থান নয়।
অন্যদিকে, অনেক বিশেষজ্ঞ বর্তমান পরিস্থিতিতে এটিকে অত্যন্ত গুরুতর বলে অভিহিত করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালে ১৯৪৫ সালে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়।
সেই বছরের আগস্ট মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলে।

