মেঘনা গুপ্তা সবকিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। ২৩ বছর বয়সের মধ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করবেন, ভারতে কয়েক বছর চাকরি করবেন এবং তারপর ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগেই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবেন।
এ লক্ষ্যে মেঘনা ভারতের বৃহত্তম আইটি প্রতিষ্ঠান টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেসের (টিসিএস) হায়দরাবাদ অফিসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানই ভারতকে বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিংয়ের শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি এমন একটি পদোন্নতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যা তাঁকে ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়েস্ট কোস্টে কাজ করার সুযোগ করে দেবে।
এখন মেঘনা গুপ্তার বয়স ২৯ বছর। তাঁর স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার পথে। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এইচ-১বি ভিসা কর্মসূচিকে ওলট–পালট করে দিয়েছে। এই ভিসা ব্যবহার করেই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো তিন দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষ কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসত।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে এই ভিসার ফি বছরে প্রায় দুই হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ ডলার করা হয়েছে। এই ভিসা ফি বৃদ্ধির ফলে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভিসার নতুন খরচ চাপিয়েছে। যেখানে একজন এইচ-১বি ভিসা পাওয়া কর্মীর ন্যূনতম বেতন হওয়ার কথা ৬০ হাজার ডলার, সেখানে এখন নিয়োগকর্তার খরচ ন্যূনতম ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানই হয়তো কম বেতনে একই দক্ষতার মার্কিন কর্মী খুঁজে নিতে চাইবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী নীতির অংশ হিসেবে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় দক্ষ কর্মীদের নিয়োগে চাপ দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের হাজার হাজার তরুণ, যাঁরা এখনো ‘আমেরিকান ড্রিম’ বা মার্কিন স্বপ্নে বিভোর, তাঁদের জন্য এটি বড় এক ধাক্কা। এই ধাক্কা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে ভারতে।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে ঠিকই, তবে উন্নত দেশগুলোর কাছে তারা নিজেদের দক্ষ তরুণদের হারাচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে বেশি এইচ-১বি ভিসার পৃষ্ঠপোষকতা করত। তারা এই ভিসা ব্যবহার করে ভারতীয় কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেত এবং চুক্তির ভিত্তিতে তাদের দক্ষ কর্মী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সরবরাহ করত।
কিন্তু এই দৃশ্যে পরিবর্তন এসেছে। ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি এইচ-১বি ভিসা পাওয়া ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭টিই ছিল ভারতীয় বা ভারতে প্রতিষ্ঠিত। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ৪–এ নেমে আসে।
আর ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে মেঘনা গুপ্তার প্রতিষ্ঠান টিসিএস ছিল শীর্ষ ১০ এইচ-১বি ভিসা প্রাপকের তালিকায় একমাত্র ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। এ তালিকার বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, মেটা ও অ্যাপলের মতো বড় বড় মার্কিন প্রতিষ্ঠান।
তবে এত দিন যা বদলায়নি, তা হলো মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের এইচ-১বি ভিসায় নিয়োগ করত, তাদের জাতীয়তার পরিচয়। ২০২৪ সালে প্রযুক্তি থেকে শুরু করে চিকিৎসা—এসব খাতে ৭০ শতাংশের বেশি এইচ-১বি ভিসা ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া হয়েছিল। চীনের নাগরিকেরা ১২ শতাংশের কম ভিসা পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল।
এখন ভারতজুড়ে হাজার হাজার তরুণের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার এ পথ সজোরে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
ট্রাম্পের ফি বৃদ্ধি সম্পর্কে আল-জাজিরাকে মেঘনা গুপ্তা বলেন, ‘এতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।’
ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের ১০ হাজার মানুষের শহর বাগেশ্বরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা গুপ্তা বলেন, ‘আমার সারা জীবনের পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়া। আমার সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।’
মেঘনা গুপ্তা বলেন, ‘তথাকথিত “আমেরিকান ড্রিম” এখন এক নিষ্ঠুর রসিকতার মতো মনে হচ্ছে।’
ঋণের বোঝায় জর্জর
মেঘনা গুপ্তার সংকটটি আজকের ভারতের এক বৃহত্তর বৈপরীত্যকে তুলে ধরছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকারের লোকজন প্রায়ই বলে থাকেন, ভারত বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি।
চলতি বছরের শুরুতে জাপানকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জার্মানির পর ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অধিকারী দেশের তালিকায় উঠেছে। তবে দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ তরুণ কর্মী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তার তুলনায় নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে অনেক কম, যা কর্মসংস্থানের ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ভারতের বড় বড় শহর অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো, খানাখন্দে ভরা রাস্তা, যানজট ও ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের চাপে নুয়ে পড়ছে।
ফলস্বরূপ গুপ্তার মতো লাখ লাখ মানুষ পশ্চিমে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে। তাঁরা প্রকৌশল বা চিকিৎসার মতো পেশা বেছে নেন। ভারতের সেরা কলেজগুলোতে কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুযোগ পেয়ে লেখাপড়া করে বিদেশে পাড়ি জমান।
গত পাঁচ বছরে ভারত থেকে দক্ষ পেশাজীবীদের বিদেশে যাওয়ার হার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) ক্ষেত্রে। এই পেশাজীবীরা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে চলে যাচ্ছেন।
ভারতীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৪ হাজার ১৪৫, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬২৯–এ, অর্থাৎ এই কয় বছরে ২৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ট্রাম্পের নতুন ভিসা নীতি এখন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ কর্মীদের এই প্রবাহ কার্যত বন্ধ করে দিতে পারে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে বেশ কিছু টানাপোড়েন চলছিল, যার মধ্যে এই ভিসা ফি বৃদ্ধি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের ওপর নয়াদিল্লিকে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে, যার অর্ধেকই ধার্য করা হয়েছে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এই অর্থ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ক্রেমলিনের যুদ্ধে সহায়তা দিচ্ছে।
দিল্লিভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতের সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তব আল-জাজিরাকে বলেছেন, নতুন ভিসা নীতির পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেসব খাত, যেগুলোতে ভারতীয় পেশাজীবীদের আধিপত্য রয়েছে। যেমন মাঝারি স্তরের আইটি পরিষেবা, সফটওয়্যার উন্নয়ন, প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং অর্থ ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাক-অ্যান্ড সাপোর্ট।
শ্রীবাস্তব বলেন, এসব পদে এক লাখ ডলারের বার্ষিক ভিসা ফি অনেকের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নতুন কর্মীর বার্ষিক বেতনের চেয়েও বেশি, যা ছোট প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতাকে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক করে তুলবে।
সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা বলেন, একজন বিদেশি কর্মী নিয়োগের খরচ এখন স্থানীয় কর্মী নিয়োগের খরচকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটি মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগের হিসাব-নিকাশ বদলে দেবে।
শ্রীবাস্তব বলেন, মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আরও বেশি অভ্যন্তরীণ প্রতিভা খুঁজবে, এইচ-১বি ভিসা শুধু সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের পদগুলোর জন্য সংরক্ষণ করবে এবং সাধারণ কাজগুলো ভারত বা অন্যান্য অফশোর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেবে।
অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ট্রাম্পের ঘোষণার পর পতনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজার ইতিমধ্যেই এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রে কর্মী নিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে।
শ্রীবাস্তবের মতে, ভারতীয় এসটিইএম স্নাতক ও শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা নিয়ে পুরোপুরি নতুন করে ভাবতে হবে।
১২০টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত নর্থ আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টসের প্রতিষ্ঠাতা সুধাংশু কৌশিকের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের ‘উদ্দেশ্য হলো এইচ-১বি ভিসাধারী এবং অন্য অভিবাসী ভিসাধারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া’।
কৌশিক আল-জাজিরাকে বলেন, অভিবাসীদের মনে করিয়ে দেওয়া যে তাঁরা এখানকার নন। যেকোনো সময়, যেকোনো খামখেয়ালিতে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সম্ভাবনা অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন ও অসহনীয়ভাবে অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পরপরই এ ঘোষণা এসেছে, যখন ভারত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশসহ অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ক্লাস শুরু করেছেন। ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে যান।
সাধারণত এ ধরনের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ পড়াশোনা শেষ করে কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যায়। ন্যাশনাল সার্ভে অব কলেজ গ্র্যাজুয়েটসের এক বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে স্নাতক হওয়া ৪১ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ২০২১ সালেও যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা প্রায় ৭৫ শতাংশ।
তবে কৌশিক মনে করেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তিনি তাঁদের হটলাইনে ৮০টির বেশি ফোন পেয়েছেন।
কৌশিক বলেন, তাঁরা জানেন যে তাঁরা ইতিমধ্যেই ঋণের বোঝায় জর্জর।
কৌশিক মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিনিয়োগ করা হাজার হাজার ডলারের টিউশন ফি এবং অন্যান্য খরচের কথা উল্লেখ করেন, যার বিপরীতে চাকরির সম্ভাবনা ক্রমে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
জিটিআরআইয়ের শ্রীবাস্তব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি ‘কম সুযোগ, কঠিন প্রতিযোগিতা এবং মার্কিন শিক্ষার ওপর কম রিটার্নের’ আশঙ্কা তুলে ধরছে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইটি ট্রেড বডি ন্যাসকম বলেছে, এই নীতির আকস্মিক বাস্তবায়ন ‘পরিবারগুলোকে বিপর্যস্ত করতে পারে’ এবং দেশের প্রযুক্তি পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চলমান অনশোর প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
সংস্থাটি আরও যোগ করেছে, ‘মার্কিন উদ্ভাবনী ব্যবস্থা ও বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারে নতুন নীতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব’ পড়তে পারে। অতিরিক্ত খরচের কারণে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘নতুন পরিকল্পনা’ করতে হবে।
তারা মানুষের জন্য একেবারেই ভাবে না
মেটার জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আন্শ ভারতের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) থেকে স্নাতক হয়েছেন। এরপরই তিনি ফেসবুকে চাকরি পান।
আন্শ এখন স্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির প্রাণকেন্দ্র মেনলো পার্কে থাকেন। তিনি একটি বিএমডব্লিউ সেডান গাড়ি চালিয়ে অফিসে যান। আন্শ ও তাঁর স্ত্রী—দুজনই এইচ-১বি ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।
গত শনিবার হোয়াইট হাউস থেকে আসা খবরে আন্শ বিচলিত হয়ে পড়েন। সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর বন্ধুদের ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। তাঁর বন্ধুরা ভারতীয় ও এইচ-১বি ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ছিলেন। একজন লন্ডনে, আরেকজন ভারতের বেঙ্গালুরুতে।
প্রধান প্রধান মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান রোববার থেকে নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছে।
এরপর ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্ট করে জানিয়েছে, নতুন ফি বিদ্যমান এইচ-১বি ভিসা বা নবায়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আপাতত আন্শের চাকরি ও যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর অবস্থান সুরক্ষিত।
কিন্তু আন্শ বলেন, এতে খুব একটা স্বস্তি নেই। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘গত ১১ বছরে আমি কখনো ভারতে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু এ ধরনের অস্থিরতা মানুষকে জীবনের বড় পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। আর এখন আমরা এখানে বসে ভাবছি, ভারতে ফিরে যাওয়া উচিত কি না?’
আন্শ বলেন, তাঁদের সংসারে কোনো সন্তান নেই। তাই ভারতে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি তাঁরা অন্তত বিবেচনা করতে পারেন। যদিও এ সিদ্ধান্ত হবে তাঁদের জীবন ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নাটকীয় এক পরিবর্তন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, তবে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুদের কী হবে, যাঁদের সন্তান রয়েছে এবং তাঁরা এইচ-১বি ভিসায় আছেন?
আন্শ বলেন, ‘মার্কিন সরকার যেভাবে এটি করেছে, তাতে বোঝা যায়, তারা মানুষের জন্য একেবারেই ভাবে না। এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো…যেন হুট করে মাথায় আসা চিন্তা। আর তারপরই এগুলো কার্যকর করে ফেলা হয়।
আন্শ বিশ্বাস করেন, নতুন ভিসা নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রেরও ক্ষতি হবে। অভিবাসীদের অবদান যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের ডিএনএতে গভীরভাবে মিশে আছে।
আন্শ বলেন, মেধা চলে গেলে উদ্ভাবন হবে না। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভিসাধারী ও তাঁদের পরিবারের ওপর পড়বে। এর প্রভাব কোনো না কোনোভাবে সবার কাছে পৌঁছাবে।
ভারতের সংগ্রাম
শনিবার হোয়াইট হাউস থেকে ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখ্য সচিব পি কে মিশ্র বলেন, সরকার বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করছে।
মিশ্রর মন্তব্য কিছু বিশেষজ্ঞের মতামতের সঙ্গে মিলে যায়, যাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন—এইচ-১বি ভিসা নীতির এই সংকট ভারতের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে এটি দেশের দীর্ঘদিনের মেধা পাচার রোধ করতে পারে।
জিটিআরআইয়ের শ্রীবাস্তব বলেন, যেসব মার্কিন প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত এইচ-১বি-এর মতো অভিবাসী ভিসার ওপর নির্ভর করত, তারা এখন আরও বেশি স্থানীয় নিয়োগ বা কিছু কাজ বিদেশে পাঠানোর কথা ভাবতে পারে।
শ্রীবাস্তব বলেন, এইচ-১বি ভিসায় এক লাখ ডলার ফি অনসাইট বা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে কর্মী পাঠানোকে খুব ব্যয়বহুল করে তুলবে। তাই ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অফশোর ও রিমোট ডেলিভারির ওপর আরও বেশি জোর দেবে।
শ্রীবাস্তব আল-জাজিরাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পোস্টিং শুধু গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এর বাইরে নিয়োগ ও প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ ভারত ও অন্যান্য অফশোর কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হবে।
শ্রীবাস্তব উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসা কিছু এইচ-১বি কর্মীকে দেশের প্রযুক্তি খাত জায়গা দিতে পারবে ভারত। যদি ওই সব কর্মী ফিরে আসতে চান। তবে তা একেবারে সহজ হবে না।
শ্রীবাস্তব বলেন, ভারতের আইটি ও পরিষেবা খাতে নিয়োগ প্রতিবছর বাড়লেও ঘাটতিগুলোও স্পষ্ট। যেমন চাকরির বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ক্লাউড ও ডেটা সায়েন্সের মতো ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রত্যাবর্তনকারীরা দেশে এলে ভারতের বিদ্যমান বেতনের চেয়ে অনেক বেশি বেতন আশা করবেন।
কৌশিক বলেন, বাস্তব অর্থ, অনেক এইচ-১বি ভিসার প্রত্যাশীরা ভারত নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে অন্য দেশের দিকে তাকাচ্ছেন।
মেটার জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী আন্শও এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আমরা প্রযুক্তির সর্বাধুনিক পর্যায়ে কাজ করি, যেখানে ভারতীয় প্রযুক্তিব্যবস্থা এখনো তাৎক্ষণিক পরিষেবা দেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী।’
এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, ভারতীয় ব্যবস্থা এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যেখানে বিশ্বের পরবর্তী বড় উদ্ভাবন করা সম্ভব। সত্যি বলতে, এটি ভারতে এখনো অনেক দূরের বিষয়।