জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামী শুক্রবার এই সনদ সই করার মধ্য দিয়ে তা ‘নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল’ হিসেবে পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করবে দলগুলো।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে দলগুলোর কাছে সনদের অনুলিপি পাঠানো হয়। তবে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের সুপারিশ দেওয়া হয়নি। সনদ সই হওয়ার পর বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে নিজেদের সুপারিশ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দেবে কমিশন। এটি জুলাই সনদের অংশ হবে না।
এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর দলগুলোকে সনদের যে খসড়া দেওয়া হয়েছিল, সেটিই চূড়ান্ত করে গতকাল দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত সনদে মূল বিষয়বস্তুর কোনো পরিবর্তন আসেনি। শুধু কয়েকটি
ক্ষেত্রে শব্দগত সংশোধন আছে। জুলাই জাতীয় সনদের তিনটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগে আছে সনদের পটভূমি। দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে আছে সনদ বাস্তবায়নের ৭ দফা অঙ্গীকারনামা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন) সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন।
তবে সব দল শেষ পর্যন্ত সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে একমত হলেও ভোটের দিন ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। কোনো কোনো দল সনদে সই করার আগে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিশ্চয়তা চায়।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। আগামী শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ সই হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সদস্যরা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দুজন করে প্রতিনিধি এই সনদে সই করবেন। ৩০টি দল ইতিমধ্যে দুজন করে স্বাক্ষরকারীর নাম কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে।
সব দলের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ পাঠানো হয়েছে। আগামী শুক্রবার ঐতিহাসিক মুহূর্তে সবার উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। আমরা আশা করছি, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে উপনীত হতে পারব।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ
তবে সব দল শেষ পর্যন্ত সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে একমত হলেও ভোটের দিন ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। কোনো কোনো দল সনদে সই করার আগে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিশ্চয়তা চায়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গত রাতে বলেন, ‘সব দলের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ পাঠানো হয়েছে। আগামী শুক্রবার ঐতিহাসিক মুহূর্তে সবার উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। আমরা আশা করছি, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে উপনীত হতে পারব।’
সনদে যা থাকছে
সনদে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কিছুটা কমানো, কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগের বিধান করা, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে দেওয়া, আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন এবং একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না—এমন বিধান করা, আস্থা ভোট ও অর্থবিল ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে আইনসভায় সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণসহ বেশ কিছু মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব আছে। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা সনদে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম পর্বে ঐকমত্য হওয়া বিষয়ের মধ্যে আছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, আইনজীবীদের আচরণবিধি, গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন, তথ্য অধিকার আইনের সংশোধন, দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে সংশোধন, দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি, আয়কর আইনের সংশোধন ইত্যাদি।
দ্বিতীয় পর্বে ১১টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য হয়। সেগুলো হলো: ১. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, ২. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান, ৪. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ— (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, ৫. জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ৬. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, ৭. সংবিধান সংশোধন, ৮. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল (এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন), ৯. নির্বাচন কমিশন গঠন, ১০. পুলিশ কমিশন গঠন, ১১. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব।
যেসব সিদ্ধান্তে ভিন্নমত
সনদে যেসব বিষয়ে কোনো কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত আছে সেগুলোর মধ্যে আছে:
১. রাষ্ট্রের মূলনীতি: এই প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফোরামের।
২. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব: কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, এলডিপির।
৩. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান: ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের।
৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা: গঠনপ্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত একমত হলেও পরের ধাপ নিয়ে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের ভিন্নমত আছে। অন্যদিকে একটি অংশে ভিন্নমত আছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। কোন ধরনের দল (নিবন্ধিত/অনিবন্ধিত) উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবে, তা নিয়ে ভিন্নমত।
৫. উচ্চকক্ষ: পিআর ও প্রার্থী তালিকা প্রকাশ নিয়ে ভিন্নতম বিএনপি ও এনডিএমের।
৬. উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়ে ভিন্নমত সিপিবি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, আমজনতার দলের।
৭. নারী আসনের বিধান: সিপিবি, বাসদ, আমজনতার দলের ভিন্নমত।
৮. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ (ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক): বিএনপিসহ ৭টি দল ও জোটের ভিন্নমত।
৯. দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা: বিএনপিসহ সাতটি দল ও জোটের ভিন্নমত।
১০. দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের একটি ধারা (নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত) সংশোধন: জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভিন্নমত।
সাত বিষয়ে অঙ্গীকার
জুলাই সনদের শেষ অংশে আছে সনদ বাস্তবায়নে সাত দফা অঙ্গীকারনামা। এই সাত বিষয়ে অঙ্গীকার করে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করবে।
১. ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।
২. জনগণের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় সাধারণত প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ গ্রহণ করছে। তাই এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে।
৩. দলগুলো সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। উপরন্তু সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে দলগুলো আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
৪. দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৫. গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
৬. সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করা হবে।
৭. যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
কিছু সংশোধন
এর আগে সনদের খসড়ায় বলা হয়েছিল, শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু, নারীসহ প্রায় ১ হাজার নাগরিক নিহত হন এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ গুরুতর আহত হন। তাঁদের আত্মাহুতি, ত্যাগ এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু-নারীসহ সহস্রাধিক নিরস্ত্র নাগরিক নিহত হন এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ গুরুতর আহত হন। তাঁদের আত্মাহুতি, ত্যাগ এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা’ ও তাঁর দোসররা পরাজিত হয়ে অনেকেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
খসড়ায় সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। চূড়ান্ত সনদে সেটা সংশোধন করে বলা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।