দেশের অগ্রগণ্য সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো অনুষ্ঠানের এবারের আয়োজনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল হক। একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল– আজীবন সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন বরেণ্য এই শিল্পী। আজ আমরা শুনব তাঁর জীবনের গল্প।
আনিসুল হক: আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো অনুষ্ঠানে। এই বিশেষ আয়োজনে আমরা আমাদের প্রাজ্ঞজনদের কথা শুনি। আজকে আমরা এসেছি বাংলাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী, বাংলার গানের শিল্পী, প্রাণের শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর কাছে। সৈয়দ আব্দুল হাদী ভাই ১৯৪০ সালে আপনার জন্ম। সে হিসাবে আপনার ৮৫ বছর পার হয়ে গেছে।
সৈয়দ আব্দুল হাদী: পার হয়ে গেছে।
আনিসুল হক: ৮৬ নম্বর বছর চলছে। আপনার একটা অপূর্ব বই আমার হাতে আছে—‘জীবনের গান’। প্রথমা থেকে বেরিয়েছে এবং তৃতীয় মুদ্রণও হয়ে গেছে।
সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।
আনিসুল হক: সত্যি সত্যি আপনার জীবনটা সংগীতের মতো সুন্দর লাগল আমার কাছে। এই বই আপনি শুরু করেছেন আগরতলার সুন্দর শৈশব, সবুজ, আবার পাথরময় পথ—সেই সব দিয়ে। তো আপনি আসলে আগরতলা ছেড়েছিলেন কত বছর বয়সে?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: আগরতলা ছেড়েছিলাম আমি, বয়সটা তো মনে পড়ছে না। তবে ক্লাস ফোর পাস করার পরে চলে এলাম।
আনিসুল হক: তার মানে ৯-১০ বছর বয়সে?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: এ রকমই হবে।
আনিসুল হক: তার মানে ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার পরে?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ। আমার বাবা তখন ওই সিলেটে কর্মরত ছিলেন, চাকরির সুবাদে। সেখানে নিয়ে গেলেন বাবা আমাকে। কারণ, বুঝতে পেরেছিলেন যে নানা-নানির স্নেহে যদি এভাবে লালিত হতে থাকি, তাহলে সম্ভাবনা কম (হাসি)।
আনিসুল হক: হ্যাঁ, আপনার শৈশব কেটেছে আপনার নানার বাড়িতে। এর কারণ একটা আপনি লিখেছেন বইয়ে। সেটা একটু বলবেন?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, সেটা হচ্ছে যে আমার জন্মের আগে আমার নানির একটি পুত্রসন্তান জন্মেছিলেন। কিন্তু জন্মের পরপরই তিনি মারা যান। তো নানির সেই সাংঘাতিক রকম অবস্থা হয়ে গিয়েছিল যে সারা দিন কান্নাকাটি করতেন। আমার বাবা দেখলেন যে তাঁকে (নানিকে) আর অন্য কোনোভাবে থামানো যাবে না। তো বাবা তখন বলেছিলেন যে ঠিক আছে, মা, এই ছেলেকে আপনাকে দিয়ে দিলাম। এটা আপনার।
এরপর নানি ওই নিজের ছেলের মতোই আমাকে মানুষ করেছেন। পরে আমার নানির আরেক ছেলে মানে আমার এক মামা হয়েছিলেন। কিন্তু সেই মামার চেয়ে বেশি স্নেহে-আদরে আমাকে মানুষ করেছিলেন। সেই যুগে উনাদের মাত্র দুজন সন্তান আমার মা এবং মামা। আর কোনো সন্তান ছিল না তাঁদের।
আনিসুল হক: আপনার ছোটবেলা কাটল আগরতলার কোন গ্রামে, মনে আছে আপনার?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: আগরতলা গ্রামে নয়, শহরেই। কারণ, নানা তখন ওকালতি করেন আগরতলা কোর্টে, শহরেই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের বোধ হয় জন্মভূমির প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ।
আনিসুল হক: আমরা যেটা বলি নাড়ির টান। নাড়ি তো ওখানে পোঁতা আছে।
সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, তো সেই টানে আমি এই কিছুদিন আগে, বছর দুয়েক আগে গিয়েছিলাম। আমি জানি না মানুষের স্মৃতি একটা অদ্ভুত জিনিস। সেই সময়কার প্রতিটি ডিটেইলস আমার মনে আছে।
আনিসুল হক: আপনি বলেছেন আপনার বইয়ে যে আমি নিজের বাড়ি নিজে খুঁজে বের করব, আমাকে তোমরা নিয়ে সাহায্য কোরো না এবং আপনি খুঁজে পেলেন।
সৈয়দ আব্দুল হাদী: একেবারে প্রথমবারেই, খুঁজতে হয়নি। গিয়ে যেখানে দাঁড়ালাম, যে হ্যাঁ, এটাই। ওটাই আমাদের বাড়ি ছিল এবং আগরতলার প্রতিটি রাস্তাঘাট এখন অনেক পরিবর্তন, অনেক—রাতদিন পরিবর্তন। কিন্তু এরপরও আমি যেমন রাজবাড়িতে গেলাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে, রাজবাড়ির দুটি জোড়া দিঘি ছিল। দুই পাশে দুটি জোড়া দিঘি ছিল, মাঝখানে রাস্তা রাজবাড়িতে ঢোকার। ঠিক তেমনি আছে। আমি ঠিকই পেয়েছি গিয়ে। নাট মন্দিরকে পেয়েছি, রাজবাড়ির যে নাট মন্দির ছিল, সেসব পেয়েছি। অবশ্য অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন। এরপরও এক অর্থে এখনো দেখলাম আগরতলা একটা সুন্দর ছিমছাম শহর।
আনিসুল হক: আপনার প্রথম স্কুলের নাম বইয়ে আছে। আপনি আপনার প্রথম স্কুল?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: উমাকান্ত একাডেমি। নামটি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রাখা। তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) একটা বিশাল মূর্তিও ওই স্কুলটার সামনে আছে।
আনিসুল হক: আর আপনার ছোটবেলায় ওই সময় রেডিও-ও ছিল না?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: না। রেডিও যখন প্রথম এল আমাদের শহরে, আমরা সব দল বেঁধে ছেলেরা গিয়েছিলাম দেখতে।
আনিসুল হক: রেডিও দেখতেও গিয়েছিলেন?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: দেখতে গিয়েছিলাম। একটা রেস্টুরেন্টে তখন রেডিওটা এসেছিল। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে দেখতাম আশ্চর্য হয়ে যে এটার ভেতর থেকে কথা বের হয়।
আনিসুল হক: তাহলে আপনি গান শুনলেন, আপনি লিখেছেন যে এই হকাররা ফেরি করে বিক্রি করার সময় যে গান গাইত, ক্যানভাসাররা সেখান থেকে বা একজন তানপুরা বাজাচ্ছে, আপনি তার কাছে গেলেন। সরোদ বাজাচ্ছে, আপনি সরোদ বাজানো শিখতে গিয়ে হাত…।
সৈয়দ আব্দুল হাদী: সেতার।
আনিসুল হক: সেতার বাজাতে গিয়ে। সেসব স্মৃতি যদি একটু বলেন…।
সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমাদের শহর তো বেশি গানবাজনার জন্য বিখ্যাত ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরিবার সেখানেই ছিল। তো আমার চেয়ে বয়সে একটু বড় কিন্তু খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল আমার, রাজা হোসেন খান। খুবই গুণী একজন সুরকার ছিলেন। আমার বাসার কয়েকটা বাসা পরেই ওদের বাসা ছিল। তো ওখানে সে রেওয়াজ করত, সেতার। আমি স্কুলে যেতাম ওই রাস্তা দিয়ে। শুনে আমার প্রচণ্ড আকর্ষণ হলো যে এটা কী, একটু শিখতেই হবে। তাঁকে গিয়ে ধরলাম যে ভাই, এটা তুমি আমাকে শিখাও। তো উনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া একজন বাদ্যযন্ত্রী এবং বাদ্যযন্ত্র তিনি তৈরিও করতেন, ওস্তাদ ছিলেন। তিনি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন, ওস্তাদ ইসরাইল। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, আমি তো এটা শিখতে চাই। তো উনি একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেন, যে আমি কি শিখতে পারব এটা? অসম্ভব। তবু তিনি বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে, এসো। তো কয়েক দিন প্র্যাকটিস করলাম। শিখলাম। একটু কোনে গতের এদিক-সেদিক শিখলাম। এরপর হাতের আঙুল তারের ঘষায়, এটা কিন্তু খুব কষ্টকর, ফোসকা পড়ে গেল। তো আমি বাজাতে পারছি না। ওস্তাদজি বলছে, বাজাও, বাবা। আমি বললাম, ওস্তাদজি, আমি পারছি না তো। উনি হাসতে হাসতে বললেন, বাবা, এটা তোমার কাজ না। তুমি বরং গান করো। আমি গুনগুন করে গান করতাম, বলছেন, গান করো। অনেক ভালো করবে। এটা তোমার কাজ না।
আনিসুল হক: এই যে আপনার একটা অনন্যসাধারণ, অভূতপূর্ব কণ্ঠস্বর, এটা ছোটবেলাতে তো আর এত ভারী ছিল না!
সৈয়দ আব্দুল হাদী: না।
আনিসুল হক: কিন্তু নিশ্চয়ই মধুর ছিল।
সৈয়দ আব্দুল হাদী: হয়তোবা। তখন তো একেবারেই…আমি তো শুরু করেছি, যখন আমার বয়স ২০-২১ বছর। তখন থেকে গান গাওয়া…এখন নিজে ওই সব গান শুনলে খুব লজ্জাই লাগে যে বাচ্চা মানুষের মতো একটা কণ্ঠ। এমনকি শুনে থাকলে বুঝবেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে প্রথম যে গানগুলো রেডিওতে তিনি গেয়েছিলেন, সেগুলোরও একই অবস্থা। এটা বোঝাই যায় না যে এটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা।
আনিসুল হক: বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর তো একটু ভারিক্কি হয়। আপনার শৈশবের ক্যানভাসারের কণ্ঠে শোনা গানগুলো কি এখন মনে আছে?
সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ।