অ) এই তো কিছুদিন আগে ফার্মগেটস্থ ইন্দিরা রোড দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন হোটেলের মাইকে প্রখ্যাত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের মধুর কণ্ঠে জনপ্রিয় গানের কলি কানে ভেসে আসছিল- “কি জাদু করিলা, পিরিতি শিখাইলা, থাকিতে পারি না ঘরেতে…”। সেই সময় মর্মস্পশী এই গানের “জাদু” কথাটি হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। আর গ্রাম বাংলায় প্রত্যক্ষ করেছি যে, ছোট বাচ্চাদের বাবা-মা আদর করে জাদু বলে কোলে টেনে নেন। এতদ্ব্যতীত পিসি সরকারের জাদুর কথা শুনেছি। ইদানিং প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, জাদুকর শাহীন শাহ, প্রিন্স আলমগীর, উলফাৎ কবির, শফিউল্লাহ শিকদার এবং আরও অনেক জাদুশিল্পী ছাড়াও অভিনেতা ও জাদুশিল্পী জনি চ্যাপলিনের জাদু টেলিভিশনে মাঝে মধ্যে দেখি। তাই কিছু দিন ধরে ভাবছি যে, জাদু নিয়ে একটি প্রবন্ধ ভিত্তিক গল্প লিখবো। বস্তুত এ বিশে^ জাদু বা ম্যাজিকের কথা শুনেনি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। আর জাদু কথাটি শুনলেই মনে হয় অ¯^াভাবিক কিছু বা মিরাকেল বা ভেল্কীবাজি বা বিভ্রম। আসলে অনেকেই এই বিষয়টি ভাল চোখে দেখে না। মূলত জাদু শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ম্যাজিয়া (Mageia) থেকে। ফার্সি ভাষায় এর অর্থ পুজারী। মোটামুটি শ্রেণির বিন্যাসের দিক দিয়ে জাদুর কার্যক্রম দুটি ধারায় চলমান। এর মধ্যে একটি বিনোদন মূলক ট্রেডিশনাল (Traditional) বা হোয়াইট জাদু এবং অন্যটি হলো কালো (Black) জাদু। আমরা প্রথমে সঙ্গতকারণেই বিনোদনমূলক জাদুর বিষয়টি তুলে ধরছি। আসলে এই ধরনের জাদু হলো পরিচ্ছন্ন বিনোদনমূলক মনোরম, মনলোভা ও আর্কষণীয় একটি শিল্প। সাধারণত আমরা মনে করি যে, এর মধ্যে হয়তো মন্ত্রতন্ত্র আছে, যার কারণে অতিপ্রাকৃতিক কিছু করা বা ঘটানো সম্ভব। আসলে এটি নিরেট ভুল ধারণা। যদি এই জাদু সম্পর্কে কিছুটা গভীরে যাই; তাহলে অনুধাবন করতে পারি যে দর্শক শ্রোতা বাস্তবতার নিরীক্ষে স্থুল মনোভাব নিয়ে জাদু দেখার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। অথচ জাদুকর (Magician) তাঁর কৌশলী বুদ্ধি ও নেতৃত্বের আমেজে মোহিত করে তুলেন এবং সূ² ধারাবাহিকতায় আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গির আড়ালে দ্রুত কাজটি সম্পাদন করার কারণে দর্শক বুঝে ওঠার পূর্বেই জাদুকর আর একটি ইভেন্টে চলে যান। আসলে একজন দক্ষ জাদুকরকে পাক্কা অভিনেতা হতে হয়। অবস্থা বুঝে নায়ক থেকে আরম্ভ করে বাবা, দাদা, ভিলেন, এমনকি নায়িকার ভূমিকাও পালন করতে হয়। জাদুকরের বুদ্ধ্যঙ্ক (IQ) তুলনামূলক কিছুটা বেশী থাকে এবং সুসজ্জিত পোশাকে একান্ত নিজ¯^তার আলোকে কথা বলেন এবং মনোমুগ্ধকর অঙ্গভঙ্গি করে দর্শক শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখেন। এ প্রেক্ষাপটে দর্শক-শ্রোতা এমন পর্যায়ে উপনীত হন যে, অনেক সময় ইল্যুশোন (Illusion) এমন কি হ্যালুসিনেশনের (Hallucination) অবস্থায় পর্যবসিত হয়ে পড়েন। তাই উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা এই জাদু খেলার মারপ্যাঁচের ধারা এত দ্রুত বুঝে উঠতে পারেন না। আবারও বলছি, এই ট্রেডিশনাল জাদুতে কোন অসাধারণ ও অবাস্তব কিছু নেই। এটা কেবল জাদুকরের নৈপুণ্যের কলা-কৌশল ও সুতী² নির্দেশণামূলক সম্মোহনী কথা-বার্তা এবং বুদ্ধির বহির্প্রকাশ মাত্র। অথচ দর্শক-শ্রোতা এটি অভাবনীয় ঘটনা বলে উপভোগ করেন এবং ঐ মুহূর্তে তাঁরা দুঃশ্চিন্তা ও দুঃখ-কষ্ট বেমালুম ভুলে যান। আর এই মর্মে দর্শক-শ্রোতা ভাবতে ভাবতে তাঁদের মাথা ঘুরপাক খেতে থাকে যে “জাদুকরের ঐ কাজটি তো অসম্ভব, তবে কিভাবে হলো”? তখন তাঁদের মনটা অনুসন্ধিচ্ছু ও একই সাথে আনন্দের আতিসয্যে বিরাজ করতে থাকে। যাহোক, স্মরণকাল থেকেই জাদুর ধারাবাহিকতা চলে আসছে। সেই গ্রীক, সুমেরীয়, মেসপটেমিয়া, মোহঞ্জেদারো-হরপ্পা, মিরশরীয়, রোমান, ইত্যাদি সভ্যতায় জাদু শিল্প তৎকালীন মানুষের জীবনে একটি অবস্থান নিয়ে বিদ্যমান ছিল। তখন অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অলৌকিকতার আদলে বিবেচনা করা হতো। যে ভাবেই বলি না কেন, অন্যান্য শিল্পকলার চেয়ে দর্শক-শ্রোতা জাদুর প্রতিটি ইভেন্টের সময় উম্মুখ হয়ে থাকেন। উদহারণ¯^রূপ- ধরুন, জাদুকর একটি সাদা রুমাল খালি থলের মধ্যে রেখে কলা-কৌশল ও সম্মোহনীপূর্বক ঐ রুমাল দিয়ে একটি কবুতর সৃষ্টি করে দেখালেন। এতে হাত তালিও কম পড়লো না! অবশ্য এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী, ইভেন্টের স্থান এবং মঞ্চের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। যাহোক, যখন জাদুকর বলেন, “এটি কিছুই নয়, কেবল কলা-কৌশল, বুদ্ধির খেলা এবং হাত সাফাই”। তখন প্রায় দর্শক শ্রোতা এটা নিয়ে কৌতুলবশত চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন এবং এর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যে ব্রতী হন। এই রহস্যজনক ও অজানা বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা প্রকারান্তরে ব্রেণ কালচার (Brain Culture বলে পরিগনিত হয়। আর এই ব্রেণ কালচার সংশ্লিষ্ট দর্শক শ্রোতাকে অধিকতর সুনিপুণ ও দক্ষ করে তুলে, যা তাঁদের বাস্তবজীবনে সিদ্ধান্ত নিতে অনেকাংশে পরোক্ষভাবে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভিমত অনুযায়ী ব্রেইণের (নিউরন) প্রধান খাদ্য দুটি- একটি গ্লুকোজ (Glucose) এবং অন্যটি হলো এই ধরনের ব্রেইন কালচার। এদিকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাদু বিনোদনমূলক উপযোগ (Utility) সৃষ্টি করে বিধায় এর চাহিদা উর্দ্ধগামী। তাই বাণিজ্যিক দিক দিয়ে এটিকে আকর্ষণীয় পণ্য (Commodity) বললে অত্যুক্তি হবে না। আর এ সূত্র ধরে বর্তমানে সারা বিশে^ এই খাতে আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আ) এতক্ষণ আমরা ট্রেডিশনাল তথা সাদা জাদু নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছি। এবার দেখা যাক, কালো জাদুটি কি এবং এর কি ধরনের কর্মকাণ্ড? মূলত কাল জাদু বলতে ¯^ার্থপরতার উদ্দেশ্যে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার বোঝায়। অনেকে আবার এটাকে শয়তানি জাদু বলে অভিহিত করে থাকেন। কাল জাদু সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য সঙ্গতকারণেই জি¦ন ও ফেরেস্তা সম্পর্কে কিছুটা তুলে ধরতে হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, জীবজগত সৃষ্টের সূত্র ধরে ইসলাম ও খৃষ্টান ধর্মে জানা যায় যে, মানুষ কাঁদামাটি, ফেরেস্তা নূরের এবং জি¦ন আগুন দিয়ে তৈরী। এদিকে সনাতনী ধর্মে ফেরেস্তা ও জি¦নকে যথাক্রমে ¯^গীয় দূত এবং দেও-দানব বলে বিবেচনা করা হয়। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এদের অস্থিত্ব (Existence) ¯^ীকৃতি পেলেও অনেক বিজ্ঞ সুধীজন এ সব কিছু বিশ^াস করেন না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে এগুলো বিশ^াস করার যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। বর্তমানে বলতে গেলে বিজ্ঞান উন্নতির শিখরে আরোহন করেছে এবং সেই সুবাদে বাস্তবতার নীরিক্ষে আমরা চার মাত্রায় (4 Dimensions) [দৈর্ঘ্য,প্রস্থ, উচ্চতা ও সময়] চলমান হলেও পাঁচ থেকে তদোর্ধ মাত্রা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, যা কেবল অনুভবে ও সূ² চিন্তা-চেতনায় বিদ্যমান। এদিকে অলৌকিকতার আড়ালে জি¦ন, ফেরেস্তা বা অশীরিরী আত্মাসমূহ আমাদের দৃষ্টির বাইরে। অবশ্য এর পেছনে কারন হলো এরা এমন এক ফ্রিকুয়েন্সী বা কম্পাঙ্কে (৩৯০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার) সৃষ্ট, যা আমাদের এই চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। তবে দৃশ্যমান জগতের সকল বস্তু বা প্রাণীর কম্পাঙ্ক এদের জানা থাকায়, এরা ইচ্ছে করলে যে কোন বস্তু বা প্রাণীর অবিকল আকৃতি বা দৃশ্যমান রূপ নিয়ে আমাদের সম্মুখ হাজির হতে পারে। তাছাড়া মুহূর্তের মধ্যে কোন কিছুকে স্থানান্তরিত করতে পারে। আর এর ¯^পক্ষে হযরত সোলায়মান (আঃ) এর সময়কালে এ ধরনের অনেক তথ্যভিত্তিক ঘটনা আছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, হয়তো আপনারা সদয় অবহিত আছেন যে, আল্লাহ তা’লার নির্দেশে আদমকে সেজদা না করার কারনে ইবলিস (জ¦ীন) তাঁর রোষানলে পড়েন। সেহেতু আদম সৃষ্টির পর থেকে চির শত্রæ বিশ^াসঘাতক জি¦ন (শয়তান) সর্ব সময় মানবের পেছনে লেগেই আছে। আরেকটি কথা, জ¦ীন নির্দেশ অমান্য করে গুরুতর অপরাধ করলেও অনুনয়-বিনয়পূর্বক প্রার্থণাক্রমে আল্লাহ তা’লা তাকে অসীম ক্ষমতা দান করেন। তাই জি¦নের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা থাকার সুবাদে ভূত-ভবিষ্যৎ জানার অধিকারী হয় বিধায় অনেক সময় চতুর্থ আসমান পর্যন্ত যেয়ে আগে-ভাগেই তথ্যাদি মানবজাতিকে অবগত করার কারনে অনেক সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। তখন এটা নিরসনকল্পে আল্লাহ তা’লা তাদের আসমানের সংশ্লিষ্ট স্থানে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এটা সত্য যে, আশরাফুল মাখলুকাত বিধায় মানবের ক্ষমতাও কম নয়? মানুষেরাও সাধনা বলে অনেক জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার সক্ষমতা রাখেন এবং অনেক ক্ষেত্রে জ¦ীন ও ফেরেস্তাকে অতিক্রম করে থাকেন। এদিকে অতীন্দ্রিয়বাদ (ভূত তথা অতীত ও ভবিষ্যৎ) জানার একটা মাধ্যম আছে, যাকে “জিওম্যান্সি” (এবড়সধহপু) তথা গুপ্ত বিদ্যা বলে। সংক্ষেপে যদি বলি, তাতে জিওম্যান্সির অর্থ হলো প্রকারান্তরে ভূত-ভবিষ্যৎ জানার গণনা বিদ্যা। অবশ্য এ বিদ্যা হযরত ইদ্রিস (আঃ) এবং হযরত ঈশা (আঃ) জানতেন। তাছাড়া এ ব্যাপারে হযরত মুসা (আঃ)ও কম ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা যা দেখাতেন, তা হলো মোজেযা। অনেকে এটি যাদু বলে অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু এটি মোটেই ঠিক নয়। আর সঙ্গতকারণেই আমাদের প্রাণপ্রিয় শেষ নবীজির (সঃ) মোজেযার কথা এখানে টেনে আনছি না।
ই) এই বিশ^ সংসারে অনেক গনক বা তথাকথিত জ্যোতিষী অথবা মায়াবিনী বা ঐন্দ্রজালিক বা ডাইনী আলৌকিকতার আলোকে অভাবনীয় ঘটনা ঘটালেও সেগুলো মোজেযা নয়, এটি কালো জাদু বলে অভিহিত। যতদূর তথ্যাদি নিয়েছি, তাতে প্রতিভাত হয়েছে যে কালো প্রপঞ্চের সূত্র ধরে জাদু-টোনা এবং বান দিয়ে অনেক মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়ে থাকে বিধায় পবিত্র তাওরাত এবং আল-কোরআনে এদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নাকি মন্ত্র বা কুফরী কালামের মাধ্যমে জি¦ন ও অশরীরির আত্মাকে হাজির করে এ ধরনের অনৈতিক কার্যক্রম সংঘটিত করা হয়ে থাকে। বস্তুত অতি প্রাচীনকালে কালো জাদুর উৎপত্তি অশরীরি আত্মা ও জি¦ন ভিত্তিক আদিম উপাসনার আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতকে অশিক্ষিত এবং সাধারণ মানুষ ছাড়াও শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণির মাঝে এটি সুপরিচিত হয়ে উঠলেও সমস্যা বাধে সাদা ও কালো জাদুর বিস্তৃতি ও পরিধি নিয়ে। তবে এক্ষেত্রে কোন পর্যন্ত হলে কালো জাদু হিসেবে বিবেচিত হবে, সেই বিষয়ে উইলিয়াম পারকিন্সের পোসথুমোস ১৬০৮ সালে একটি নির্দেশিকায় উল্লেখ করেন। এদিকে ২০০৯ সালে রবার্ট এম প্লেসেস কর্তৃক লিখিত “জাদু ও রসায়ন” বইতে উল্লেখ করা হয় যে, কালো জাদুর সমান্তরালে রয়েছে অশরীরি আত্মার ঘনিষ্ঠতা লাভে আদিম শামানিষ্টিক প্রচেষ্টা। আর আধুনিক কালো জাদুতে যে আচার অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছে; তাহলো একই আত্মাকে আহবান করতঃ তার মাধ্যমে চর্চাকারী কর্তৃক চাহিত ইতিবাচক ফলাফল লাভের উদ্দেশ্যকে ঘিরে। তিনি (প্লেসেস) সাদা ও কালো জাদুর পরিধি ও বিস্তৃতির উপর একটি আধুনিক সংজ্ঞাও দিয়েছেন। তবে এ সংজ্ঞায় জাদুর শ্রেণীর উপর গুরুত্ব না দিয়ে চর্চাকারীর প্রয়োগের উপর জোর দিয়েছেন। কথা প্রসঙ্গে আধুনিক বিনোদন জগতের অন্যতম পুরোধা হিসেবে জিন ইউজেন রবাট হাউডিনের কথা উঠে আসে; যিনি ১৮৪৫ সালে প্যারিসে একটি জাদু থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে হেনরি এন্ডারসন লন্ডনে একই পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিক হতে বিভিন্ন দেশের বড় বড় নাট্যমঞ্চে জাদু প্রদর্শন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে তো বলতে গেলে বিশ^ব্যাপী নাট্যমঞ্চ, টেলিভিশন, জন্মদিন, গায়ে হলুদ ও বিয়ে সহ বিভিন্ন কর্পোরেট শো’তে বিনোদনের একটি আর্কষণীয় ও জনপ্রিয় মাধ্যমে হিসেবে সমহিমায় এগিয়ে চলেছে।
ঈ) বাস্তবতার ধারের কাছেও নেই, এমন কোন অভাবনীয় কর্মকাণ্ড দেখলে; আমরা সাধারণত অলৌকিক বা আশ্চর্যজনক বিষয় বা জাদু বলে অভিহিত করে থাকি। এ প্রেক্ষাপটে আরব্য রজনীর সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের কথা হয়তো মনের আঙ্গিনায় উঁকি ঝুঁকি দিতে পারে। এদিকে মনুষ্য জাতি বিশেষ করে আমরা বাঙ্গালীরা সাধারণত কুসংস্কারের আদলে আলৌকিকতার উপর দুর্বল। যখন আমরা কোন সমস্যায় পড়ি, কিম্বা যদি দুরারোগ্য ব্যাধি হয়, কিম্বা প্রেমিকা আর আগের মতো প্রেমিককে কাছে পায় না, কিম্বা কাকে বশে আনা, কিম্বা মেয়ের বিয়ে হয় না, কিম্বা শত চেষ্টার করে চাকরি-বাকরি হয় না, কিম্বা বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকা দিয়ে বিদেশ যাওয়া তো দূরে থাক বরং প্রদত্ত টাকাও ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তখন উপায়ন্তর না দেখে গনক বা অপজ্যোতিষীর দ্বারাস্থ হই। এ ধরনের কুসংস্কার বা রহস্যময়ী কার্যাবলীতে কতদূর সফলতা হয়ে থাকে, তা সম্মাšি^ত পাঠকবর্গের উপর ছেড়ে দিলাম। তবে গনক বা জ্যোতিষীর কথা যে সঠিক হয় না, তাও বলা সম্ভব নয়। কেননা এটা সত্য যে, কতিপয় জ্যোতিষী বা গনক পঞ্চমাত্রা কিম্বা তার উর্দ্ধে বিচরণ করে বিধায় তাঁদেরকে অযথা দোষারোপ করা সমীচীন নয় বলে মনে করি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আমাদের জনপদে একটি প্রবচন প্রায়ই শুনা যায়; তাহলো “ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে”। এটা সামনে রেখে একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরছি। আশির দশকে ফরিদপুর শহরের মধ্যে অবস্থিত “খান ভিলা” নামে একটি ছয় তলা ভবনের ছাদে খেলারত তিন বছরের শিশু হঠাৎ নিচে মাটিতে পড়ে গেলে পুরোপুরি অক্ষত থাকে। এ প্রেক্ষাপটে অনেকে বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেন যে শিশু বাচ্চাটি তো ফেরেস্তা, তাই হয়তো তার কাঁধের ফেরেস্তা বাঁচিয়েছেন। আবার কেউ এও কথা বলেন যে, “রাখে আল্লাহ মারে কে”? তাছাড়া কোন কোন লোক বলেন যে, ভাল জ¦ীন তাকে বাঁচিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমি মনে করি যে, মধ্যাকর্ষণের আওতায় হয়তো এমন নিরাপদ এ্যাংগেল ধরে ঐ শিশু বাচ্চাটি নিচে পড়েছে। তাই হয়তো বাচ্চাটি পুরোপুরি অক্ষত ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। সেহেতু এখানে কোন ¯^র্গীয় আলৌকিকতা বা জাদু আছে কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠে আসে।
উ) জাদু, বিশেষ করে সাদা কিম্বা কালো জাদু নিয়ে যতই লম্বা লম্বা কথা বলি না কেন, জাদু বলতে আমরা ট্রেডিশনাল সাদা জাদুকে বুঝে থাকি, যা একটি বিশেষ কলা (ঝঢ়বপরধষ অৎঃ) হিসেবে নির্মল আনন্দ দিয়ে থাকে। সেহেতু দেশ হোক, আর বিদেশই হোক, প্রায় বড় বড় প্রদর্শনী বা কর্পোরেট শো বা মেলা বা ভ্যারাইটিজ অনুষ্ঠানে এই জাদু বেশ জনপ্রিয়। কেননা এটি দর্শক শ্রোতাকে পরিচ্ছন্ন বিনোদনের সারথী ধরে মাতিয়ে রাখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, শিল্প হিসেবে জাদুকে অনেক সুধীজন ভাল চোখে দেখেন না। অনেক ক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তিবর্গ পাপ (ঝরহ) বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু এ চিন্তাধারা মোটেই ঠিক নয়। কেননা এই জাদুর কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয় না বরং পরিচ্ছন্ন আনন্দ পেয়ে থাকেন এবং এটি সাময়িক হলেও দুশ্চিন্তা থেকে মানুষকে মুক্ত রাখে। এক্ষেত্রে কিছু তথাকথিত জ্ঞানী গুণীরা আরব্য উপন্যাসের সেই জাদু টোনার আদলে নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা করে থাকেন, যার আদৌ কোন ভিত্তি নেই। এদিকে আমাদের দেশে আগে দলে দলে বেদেনীরা সর্পসহ জাদু খেলা দেখিয়ে গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া কিষান-কিষানি ও শ্রমিকদের আনন্দ দান করতো। কিন্তু এখন আর তেমনটি সচারচর দেখা যায় না এবং নানা কারণে তারা নিশ্চিন্ন হয়ে যাচ্ছে। যাহোক, এ বিশ্বে ছোট বড় মিলে ২৩০টি দেশের মধ্যে এমন কোন দেশ নেই যে, সেখানে জাদু শিল্প নেই। পূর্বেও কিছুটা বলেছি, এই জাদু অতিপ্রাকৃতিক বা মিথ্যা বা কুহেলিকা নয়। এটি দর্শক-শ্রোতার আনন্দ দেয়ার জন্য একটি মনোমুগ্ধকর শক্তিশালী শিল্প মাধ্যম মাত্র এবং এর আবেদন চিরন্তন। এক্ষেত্রে ¯^ভাবতই একটি কথা না বলে পারছি না, তাহলো মানুষের দু’ধরনের ক্ষুধা। একটি দৈহিক ক্ষুধা এবং অন্যটি হলো মনের ক্ষুধা। আর এই মনের ক্ষুধা মেটানের ক্ষেত্রে জাদুর তাৎক্ষনিক বিনোদনের বিষয়টি অনন্য সাধারন। তাই এটি খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এটা সত্য যে, প্রায়ই ক্ষেত্রে মন দেহকে পরিচালনা করে থাকে। তাই যদি হয়, তবে এই জাদু শিল্প মানুষের সমস্যাসংকুল জীবনে বড় একটা নিয়ামক বা উপহার (এৎবধঃ নড়ড়হ ঃড় ঃযব ষরভব) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। এখন যে কথাটি বলবো তা শুনে হয়তো হতবাক হবেন। এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য যে, প্রাচীন ভারতে (বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশ) সনাতনী ধর্মের সারথী ধরে যদি বলি, এই উপমহাদেশ জাদু শিল্পের আদি সুতিকাগার, তাহলে হয়তো বেশী বলা হবে না। আর এখনও পশ্চিমা বিশ^ জানে যে এই উপমহাদেশই জাদু শিল্পের আদি ভীত রচনা করেছে। এদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কতগুলো জাদুসংঘ গড়ে উঠেছে, যেমন- বাংলাদেশ জাদুকর পরিষদ, জাদুশিল্পী কল্যাণ পরিষদ, শাহমনি জাদু একাডেমী, ম্যাজিক এম আর টি, ইত্যাদি। কিন্তু নানা নেতিবাচক কারনে এ সংঘগুলো আগাতে পারছেনা। এক্ষেত্রে দুঃখের বিষয় হলো যে, অনেক দেশে শিল্পকলা প্রতিষ্ঠানে জাদুকে ঘিরে পৃথক অনুষদ বিদ্যমান। অথচ বাংলাদেশের ¯^নামধন্য শিল্পকলা একাডেমীতে জাদু শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক অনুষদ আজও পর্যন্ত অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ কোন টিভি চ্যানেলে অন্যান্য শিল্পের ন্যায় জাদুশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। তাই সরকার সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো যে, দেশীয় জাদু শিল্পের উপর ভর করে আধুনিকীরণের পথ ধরে বিকাশ লাভের মাধ্যমে মানুষের নিরানন্দ জীবনে ¯^ল্প সময় হলেও যাতে আনন্দ বয়ে আনতে পারে, সেটা নিশ্চিতকল্পে এ ব্যাপারে খোলা মনে যেন এগিয়ে আসেন। আর সব সময় মনের বাতায়নে একটি কথা লালন করা বিধেয় যে সাদা জাদু আর কিছু নয়; কেবল বিনোদনের একটি বিশেষ মাধ্যম হিসেবে পরিচ্ছন্ন শিল্প মাত্র।
সহায়ক সূত্রাদি:
০১। উইকিপিডিয়া।
০২। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।
০৩। জনি চ্যাপলিন, অভিনেতা ও জাদুশিল্পী।
০৪। ইয়াদী মাহমুদ (আলিবাবা) বিশিষ্ট সাংবাদিক।
০৫। লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা।
* জনাব চৌধুরী বিশিষ্ট অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।