কে হবে আগামীর টাইগার? ব্যাটিং–বোলিং না উইকেট কিপিং? এভাবেই কোটি শিক্ষার্থীকে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ নামে জাতীয় দলে নিজের জার্সি দেখার স্বপ্নে বুদ খুদে ক্রীড়াপ্রেমীরা। হাজারো শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন করতে নেওয়া হচ্ছে ২০০ টাকা করে। একটি প্রতিষ্ঠান আয় করছে কোটি টাকা। তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং খেলার ছলে হাজারো শিক্ষার্থী প্রতারণার শিকার হচ্ছে। গ্রাম–শহরের স্বপ্নবাজ তরুণদের স্বপ্ন ভেঙে পড়ছে। মনোবিদরা বলছেন, জীবনের প্রথম পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা যদি মানসিক ধাক্কা খায় তাহলে মনে গভীর ক্ষত হয়। শিক্ষার্থীদের আশা দেখিয়ে আশাহত করা প্রতারণার শামিল বলে মনে করছেন তারা।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রতিভাবান খুদে ক্রিকেটার সন্ধানে বাংলাদেশ (পিকেসিএসবিডি) ক্রিকেট ট্যালেন্ট হান্ট বিডি কার্যক্রম চালায়। গতবারও হাজারো শিক্ষার্থীর প্রতি ১০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি নিয়েছে তারা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নৈপুণ্যতার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র উত্তরার দুটি মাঠে কয়েকজন শিক্ষার্থী জড়ো করে নামমাত্র ট্যালেন্ট হান্ট করা হয়েছে। যারা নির্বাচিত হয়েছেন, কোথায় সুযোগ পেয়েছে? কোথায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার কোনো খবর মেলেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও এই চক্র আবারও শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখিয়ে কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। যা নিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তারাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা জনকণ্ঠকে জানান, এই বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা টাকা দিয়ে জেলা পর্যায়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। জেলায় আসতেও তাদের খরচ হচ্ছে। এরপর বিভাগ। পরে জাতীয়ভাবে ঢাকায় আনার কথা। তাদের জাতীয় দলের মতো জায়গায় খেলানোর স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। কিন্তু স্বপ্ন আর পূরণ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাউশির শারীরিক শিক্ষার কয়েক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে সরকারি একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। আর এই পরিপত্র স্কুলে স্কুলে দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে টাকা কামিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের (মাউশি) শারীরিক শিক্ষা বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি চিঠি জারি করেছে। এই চিঠি দেশের সকল জেলার শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিভাবান খুদে ক্রিকেটারদের সন্ধানে বাংলাদেশ (পিকেসিএসবিডি) ক্রিকেট ট্যালেন্ট হান্ট ২য় পর্ব ২০২৫ প্রতিযোগিতা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এতে স্বাক্ষর করেছেন উপপরিচালক শারীরিক শিক্ষা মো. শহিদুল ইসলাম। বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, মাউশির শারীরিক শিক্ষা বিভাগ এই কার্যক্রম মনিটরিং করবে। মাউশি ও অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের কোনো আর্থিক সংশ্লেষ থাকবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পিকেসিএসবিডির ওয়েবসাইটে দেখা যায় চটকদার বিজ্ঞাপন। শিক্ষার্থীদের আকর্ষণে বেশকিছু ভিডিও দেওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটে খুদে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করতেও আহ্বান জানানো হয়েছে। শর্তে বলা হয়েছে প্রতিযোগীর বয়স হবে (১২–২২) বছর। প্রতিযোগিতার বিষয়: (ব্যাটিং/বোলিং/উইকেট কিপিং)। রেজিস্ট্রেশন ফি মাত্র ২০০ টাকা। এখানে বলা হয়েছে, রেজিস্ট্রেশন করে আজই কনফার্ম কর তোমার অংশগ্রহণ!
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. সৈকতকে একাধিকবার ফোন, মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। জেলা–উপজেলা পর্যায়ের একাধিক শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি একটি চিঠি এই কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়েছে। যে কারণে হাজারো শিক্ষার্থী অনলাইনে টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছে।
সরকারি চিঠিতে যা বলা হয়েছে
জেলা শিক্ষা অফিসার তার আওতাধীন সকল উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের নিয়ে সমন্বয় সভা করবেন। ট্যালেন্ট হান্ট–২য় পর্ব ২০২৫ প্রতিযোগিতায় স্কুল ও কলেজ থেকে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন। উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার তার আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের উপস্থিতিতে বা অনলাইনে সমন্বয় সভা করবেন। ট্যালেন্ট হান্ট–২য় পর্ব ২০২৫ প্রতিযোগিতায় স্কুল ও কলেজ থেকে আগ্রহী ছাত্রদের অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন।
অনলাইনে প্রতিযোগীদের নিবন্ধন কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। প্রতিটি স্কুল/কলেজে ক্রিকেট টিম তৈরির লক্ষ্যে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে ক্রিকেট খেলায় সুদূরপ্রসারী সুফল পেতে ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান তার অধীনস্থ শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করবেন। ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণি মিলিয়ে গ্রুপ এ, অষ্টম–দশম শ্রেণি গ্রুপ বি, একাদশ–দ্বাদশ শ্রেণি গ্রুপ সি।
(এ, বি, সি) প্রতিটি গ্রুপে সর্বনিম্ন ১১ জন প্রতিযোগীকে অনলাইন নিবন্ধনে অন্তর্ভুক্ত করবেন। অনলাইনে নিবন্ধনের সময়: ২০ এপ্রিল ২০২৫ রবিবার থেকে ২৯ এপ্রিল ২০২৫ মঙ্গলবার পর্যন্ত অনলাইনে নিবন্ধন করা যাবে। যথাযথ নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করে অনলাইনে নিবন্ধন করা যাবে (শুধুমাত্র ছাত্র)। প্রতিযোগী নিজের অথবা অভিভাবকের মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার তথ্য ওই মোবাইল নম্বরে জানানো হবে। নিবন্ধন সম্পন্ন হলে ওয়েবসাইটে প্রতিযোগীর ড্যাশবোর্ডে থাকা প্লেয়ার অ্যাডমিট কার্ড, স্টেডিয়ামে এন্ট্রি টিকিট, অংশগ্রহণমূলক সার্টিফিকেট ডাউনলোড ও প্রিন্ট করে নিতে হবে। প্রসঙ্গত, সারাদেশে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে ৪০ হাজার স্কুল কলেজ রয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, জেলা বাছাই কমিটিতে আহ্বায়ক জেলা শিক্ষা অফিসার, সদস্য উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (সকল)। সদস্য সচিব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (আহ্বায়ক কর্তৃক মনোনীত)। উল্লেখ্য, (ব্যাটিং, বোলিং, উইকেট কিপিং) প্রতিটি ক্ষেত্রে একক দক্ষতার ভিত্তিতে তিনটি গ্রুপ (এ, বি, সি) থেকে মোট ২৬৪ জন উত্তীর্ণ হবে। প্রতিটি গ্রুপে ৮টি ক্রিকেট টিম তৈরির লক্ষ্যে এই বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। জেলাভিত্তিক মোট ২৪টি ক্রিকেট টিম তৈরি হবে।
যা বলছে শারীরিক শিক্ষা বিভাগ
এ বিষয়ে মাউশির শারীরিক শিক্ষা উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এই বিভাগে নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এজন্য এতকিছু জানতাম না। তারা যে শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা নিচ্ছে সেটিও জানা ছিল না। ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানকে আর কোনো কাজ দেওয়া হবে না।’
প্রথম বছর এই হান্ট করার ফল কী? ক্রিকেটে কি উন্নতি হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা অবহিত নয়। পিকেসিএসবিডি জানিয়েছিল করোনার কারণে সেবার ট্যালেন্ট হান্ট ভালো মতো করা যায়নি। কিন্তু এবার সাড়া কম পাওয়া গেছে। যে কারণে আমরা আর আপত্তি করিনি। কেন একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এভাবে সরকারি চিঠি পাঠানো হলো এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ‘শারীরিক শিক্ষায় মন্ত্রণালয়ের কোনো বাজেট, তেমন কার্যক্রম নেই। সেই বিবেচনায় পাঠানো হয়েছিল। এটি আর হবে না।’