সার্কাসে জীব–জন্তু নিয়ে খেলা দেখানো নিষিদ্ধ; কিন্তু তাতে তো আর খেলা দেখানো বন্ধ থাকে না। সার্কাসের মানুষই সেজে আসে নানা জন্তুরূপে। শিশুদের ভোলাতে হরবোলা (বিভিন্ন পশু-পাখির ডাক নকল করে যে ব্যক্তি) মানুষ ডেকে যায় ওই জন্তুর স্বরে। আবার সাইকেলে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে কেউ কেউ পাখি হয়ে ওঠে। পাখি হয়ে উড়ে যায় শিশুদের চোখে। কেউ কেউ খেলা দেখায় শরীরে গলিয়ে নিয়ে আগুনের বলয়। সার্কাসের এসব খেলার ভেতর ঢুকে যায় শিশুরা। ঠিক যেভাবে সবকিছু থামিয়ে আগুনের বলয়ে ঢুকে গেল রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছোট ছোট শিক্ষার্থী।
২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। যেই ঘরে ক্লাস করছিল প্রাথমিক স্কুলের শিশুরা, নিচ্ছিল জীবনের পাঠ, সেই ঘরেই ঢুকে বিধ্বস্ত হয় যুদ্ধবিমানটি। এর পরই আগুন ধরে যায় স্কুল ভবনে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ জনের নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। এর মধ্যে অধিকাংশই খুদে শিক্ষার্থী।
সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য ইউনিফর্ম পরেছিল শিক্ষার্থীরা। নিশ্চয়ই মা তাদের কারও দুই বেণি করে দিয়েছিলেন, কারও সিঁথি করে চুলে চিরুনি করে দিয়েছিলেন; সাজিয়ে দিয়েছিলেন টিফিন বক্সও। আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ওরা স্কুলে গিয়েছিল। ছুটি হলে আবার ঘরে ফিরবে তারা; কিন্তু ফিরতে পারেনি। ছুটির কিছুক্ষণ আগেই বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমানের ওই আগুনের বলয় তাদের টেনে নিয়ে বাজিয়ে দিয়েছে অনন্ত ছুটির ঘণ্টা। ঘটনার পরেই একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, পরনের সব কাপড়চোপড় পুড়ে গেছে, পুড়ে গেছে ছোট্ট শরীর। পোড়া এক পা খালি আর এক পায়ে স্কুলের জুতা নিয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে ছোট্ট এক শিক্ষার্থী। সে চিৎকার করছে; কিন্তু ভিডিওতে তা শোনা যাচ্ছে না। চোখ বুজে অনুভব করি, তার থিতিয়ে আসা বেদনার ভাষা। এ দৃশ্যে বিষণ্নতা জাপটে ধরে থাকে। বুকে চাপ লাগে খুব। আর অসহ্য ব্যথায় ভেসে যায় চরাচর।
মাতৃশূন্য দুপুরে পোড়া শরীর নিয়ে অনেকটা সময় আকুল হয়ে ছোটাছুটি করেছে শিশুটি। যেন একটা ছোট্ট নদী স্রোত হারিয়ে কেঁদে ফেলছে হাউমাউ। এত এত লোক সামনে, তবু সে সেদিন জানেনি, আর কতদূর গেলে ‘মানুষ’ পাওয়া যাবে! তবু সে এগোতে থাকে। মানুষ এগিয়ে গেলে নিশানা সরে যায়—পথ সরে যায়। তার সঙ্গে আর দেখা হয় না কারও। তারপর সব আর্তনাদ ভারী পাথর হয়ে থাকে।
আচ্ছা, আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে ওই শিশুটি কি হৃদয়চেরা আর্তনাদ করেছিল? না জানলেও আঁচ করতে পারি। সে হয়তো অসহায় বালকের গলায় ‘মা, মা’বলে চিৎকার করেছিল। চেয়েছিল মায়ের শুশ্রূষা। চেয়েছিল, ভেজা গামছা দিয়ে পরম মমতায় মা মুছে দিক পোড়া ক্ষত। হয়তো মনে মনে আর্তি জানিয়েছিল—‘সব পুড়ে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে সব। আমায় একটু জলের ওপর ভাসিয়ে রাখো, মা।’ আর ওদিকে মা সন্তানের খোঁজে হয়তো দিশাহারা। ভিড়ের ভেতর, আগুনের ভেতর, পোড়া গন্ধের ভেতর বুকের জাদুকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছেন তিনি।
চোখে তিন ভাগ জল আর এক ভাগ দেখা নিয়ে ছুটছেন মায়েরা, স্বজনেরা। দূর থেকেও স্পষ্ট সেই জলের ভাষা। একদিন নদী শুকিয়ে যায়; কিন্তু কান্না শুকায় না। সেই কান্না নিয়ে সামনে আসা প্রতিটি শিশুর মুখকেই নিজের সন্তানের মুখ ভেবে একবার করে দেখে নিচ্ছেন। আসলে সব সন্তানের মায়েরা তো আদতে একজনই, আর তিনি হলেন ‘মা’। সেটি আরও একবার বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন শিশুদের বাঁচাতে নিজের জীবন হারানো মাইলস্টোনের শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী। তাঁর স্বামী মনসুর হেলাল বলেছেন, ‘আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না। সে বলেছিল—ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি।’ আসলে মায়ের কোনো কোনো দেশ হয় না, ধর্ম হয় না, জাত হয় না। মা, আর সবার মা।
এই শিশুদের তো সবে শৈশব শুরু। তাদের কেউ কেউ হয়তো স্কুল ছুটির পর বাড়ি গিয়ে কাগজের প্লেন ওড়াত! হ্যাঁ। তবে তাদের কাছে প্লেন বলতে ভাঁজ করা কাগজ। সাদা বা রঙিন। আর তাতে যাত্রী কেবল আনন্দ। হাসি হাসি শিশুমুখে ফুঁ দিয়ে কাগজের প্লেন ছুড়ে দিত শূন্যে। আর আনন্দ যাত্রী নিয়ে সেই প্লেন চলে যেত দূরে। দূর বলতে, এক দৌড় সমান দূরত্ব। আর সেখানেই আছড়ে পড়বে, বিধ্বস্ত হবে কাগজের প্লেন। কিন্তু এতে মলিন হবে না আনন্দ। পুড়বে না যাত্রী। অথচ কাগজের প্লেন ওড়ানো বয়সে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে চলে গেল কতকগুলো ছোট ছোট প্রাণ। শৈশব মানে তো ‘পুড়ে মরো রোদ্দুরে, কাদা মাখো বর্ষায়।’ অথচ এই ঘন বর্ষার দিনে রোদ্দুর নয় জেট ফুয়েলের পোড়া আগুনে পুড়ে মরল তারা। এই দৃশ্য দেখা যায় না। এই দৃশ্যে চোখ বন্ধ করে রাখতে হয়। কারণ, চোখ খুলে গেলেই শূন্য হয়ে যায় সামনের সব পথ।
খবরে জানা গেছে, এখনো কোনো কোনো শিশু পোড়া শরীর নিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। বাবা–মা এখনো খুঁজে পায়নি তাদের। তারাও হাসপাতালে দেখেনি মা–বাবার মুখ। সন্তানদের খুঁজতে গিয়ে অনেক মা-বাবাও তো আহত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন। একটি ছবিতে দেখা গেছে, হাসপাতালের বেডে এমন দুজন শিশু শুয়ে শুধু কাঁদছে। কাকে কী বলবে বুঝতে পারছে না। ভয়ে সব ভাষা হারিয়ে গেছে তাদের। স্কুল ইউনিফর্মের ফুল। মায়া হয়ে আছে। অপলক দেখি মুখ। বইছে অবিরাম ব্যথার উথালপাতাল হাওয়া। ভাষাহীন, তবু কী মনে মনে ওই দুই শিশু বলছে না—‘আমাকে শনাক্ত করো কেউ। আমার মনের ভেতর যে ব্যথা, পোড়া শরীরের ভেতর যে জ্বলুনির সুর, তাকে কেউ হা হা চিৎকার দাও। যদি পারো মাকে এনে দাও।’
এসব স্মৃতি অনেক তাড়িয়ে বেড়াবে। তাড়িয়ে বেড়াবে যেসব শিশু হাসপাতাল থেকে পোড়া ক্ষতে উপশম নিয়ে আবার স্কুল শুরু করবে তাদের; তাড়িয়ে বেড়াবে আগুনের সময় শিশু–কিশোর হয়েও যারা আর সব শিশুদের উদ্ধারে জীবন বাজি রেখেছিল তাদের; তাড়িয়ে বেড়াবে সন্তানহারা বাবা–মা, স্বজন, মাতৃহারা শিশু আর যারা ‘মানুষ’ তাদের। এই স্মৃতির ভার বহন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। ঔপন্যাসিক ইয়োকো ওগাওয়ার ‘মেমরি পুলিস’ উপন্যাসে দেখা যায়, জাপানের অজ্ঞাত একটি দ্বীপের বাসিন্দারা ধীরে ধীরে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল। এই ভুলে যাওয়া বা স্মৃতি হারানোকেই তারা স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কারণ, তাদের কাছে স্মৃতি ফেরানোর কোনো ওষুধ ছিল না। মনে মনে প্রার্থনা করি, জাপানের ওই অজ্ঞাত দ্বীপের মতো আমাদেরও এই স্মৃতি হারিয়ে যাক, অন্তত ছোট ছোট শিশুর মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাক এই স্মৃতি। যেসব শিশু আর কোনোদিন ফিরবে না আমাদের কাছে, তারা স্কুল ছুটির অপেক্ষায় ছিল। মঙ্গলবার পর্যন্ত বিধ্বস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে পড়ে ছিল পোড়া খাতা, পোড়া বই, পুড়ে যাওয়া ব্যাগ ও আধখাওয়া টিফিন। খাওয়ার সময়টুকুও পায়নি তারা। আর ছিল সুন্দর হাতের লেখায় মেহরিমা জাহান রূপন্তি নামে তৃতীয় শ্রেণির এক শিশুর ছুটির আবেদনপত্র। এই ছুটি তার মঞ্জুর হয়েছিল কি না, জানা নেই; কিন্তু তাদের অন্তত ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে হঠাৎ। এই ছুটি তাদের পোড়া শরীরে লাগিয়ে দিয়েছে অদৃশ্য ডানার পালক। একা একা তারা প্রদক্ষিণে যাচ্ছে অনন্ত নগরে।
এমন দৃশ্যের পরও আকাশে চাঁদ উঠবে। আর সব তুচ্ছ জ্ঞান করে সবাইকে চমকে দিতে উজ্জ্বল তারা হয়ে ফুটে উঠবে শিশুরা। চাঁদের পাশ থেকে ঝুঁকে তারা কাকে দেখবে প্রথম—মা–বাবাকে; বন্ধুদের; ছেড়ে যাওয়া পোড়া জুতা নাকি দূরে চলে যাওয়া মানুষকে?