সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: কখনও শীত, কখনওবা বসন্ত, কালের আবর্তনে একসময় বর্ষাও আসে। কিন্তু হিমেলের অফিস সেই সকাল আটটা থেকে শুরু আর শেষ কখন হয় আজ অবধি এ নিয়মের কোনো ব্যতয় ঘটেনি। এরই মাঝে পিতৃহীন হিমেলের ফোনে কথা হয় তার মায়ের সাথে, একমাত্র কন্যা টুম্পার সাথে, প্রিয়তমার স্ত্রীর সাথেতো থাকলোই। কেননা ঢাকা শহরে একাকী জীবনে ফোনই যোগাযোগের উত্তম মাধ্যম।
স্কুল শিক্ষিকা শ্রাবণীর সংসারে ঝামেলার বালাই নেই বললেই চলে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে প্রিয়তমার অফিসের সাঁজগোছ
পর্যন্ত শাশুড়ীই করে থাকেন। স্কুল থেকে না ফেরা অবধি নাতনির আগলে রাখার দ্বায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে কখনো তিনি ব্যর্থ হননি। বৌমা ফেরার সাথে সাথে খাবারের প্লেটটাও তিনিই দিয়ে থাকে। তারপরও মায়ের বিরুদ্ধে শ্রাবণীর অভিযোগের শেষ নেই। তোমার মা এটা করে না, ওটা করে নাই… সেকেলে… আটপৌরে কিংবা শিক্ষার বালাই নেই। দশমিনিট কথা হলে নয় মিনিটই থাকে মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ।
এমনিতেই বৈশ্বিক মহামারীতে চাকরির বাজার অস্থির। প্রতিমুহূর্তে থাকে চাকরি হারানোর শঙ্কা। কাজের সীমহীন প্রেসার। তারপর বউয়ের বিরতিহীন অভিযোগ। এতো যন্ত্রনা তাকে বেশ অস্থির করে ফেলে। তারপর আজ শ্রাবণী বলেই ফেললো তোমার মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও। অশিক্ষিত আর আটপৌরে আচরণ আমাদের মামনির উপর পড়বে। আর টুম্পাও তোমার মায়ের মতো অশিক্ষিত আটপৌরে হবে। তাছাড়া উনি বেশ নোংরামোও করে। একাবিংশ শতাব্দীতে এসেও তোমার মায়ের পান খাওয়ার অভ্যেস আর গেলো না। জানো, গতকাল টুম্পার দেখি গাল টকটকে লাল। জিজ্ঞেস করতেই বলে দিদার সাথে পান খেয়েছি। বুঝেছো অবস্থাটা?
হিমেল বোঝানোর চেষ্টা করে… বলে মা হলো বটগাছের মতো। তোমাকে, আমাকে সবাইকে ছায়ার মতো করে রেখেছে। সহজ যুক্তি অতি সহজেই শ্রাবণীর কাছে বেলোয়ারী চুড়ির মতো ভেঙে তছনছ হয়ে যায়।
হিমেল বোঝানোর চেষ্টা করে… বলে মা হলো বটগাছের মতো। তোমাকে, আমাকে সবাইকে ছায়ার মতো করে রেখেছে। সহজ যুক্তি অতি সহজেই শ্রাবণীর কাছে বেলোয়ারী চুড়ির মতো ভেঙে তছনছ হয়ে যায়।
দিন যায় কটু কথার তিক্ততায় মা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে নাতনিটা তার দিদার পক্ষে ছোটমুখে দু’চার কথা বলতে চায়। এতে তার উপর নেমে আসে বিভৎস নির্যাতন। মায়ের চোখ দিয়ে জল চলে আসে। নাতনিকে আগলে রাখার চেষ্টা করে। শেষ বয়সে এসে এগুলো তার শরীরে বিষের মতো বিধে উঠলো। উপায়ান্তর না পেয়ে অবশেষে মা তার বৌমাকে বলে নিজের বাড়ি ফিরে গেল। তার সন্তানকে শুধুই বললো সে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।
এদিকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো শ্রাবণী উড়তে শুরু করলো। স্বামীর সাথেও যোগাযোগ কমতে কমতে একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অফিসে আসার পথে সন্তানকে নিজের মায়ের কাছে রেখে আসে। কখনো ফেরার পথে বাসায় আনে… কখনোবা আনে না… এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার সাবেক প্রেমিকের উপর। সে বাসায় আসলে সন্তানকে বাসায় আনার প্রশ্নই আসে না। সর্ট ট্যুর, লং ট্যুর আরও কত কি। বিষিয়ে উঠা জীবন কেমন যেন এক পশলা বৃষ্টি তার সারা শরীর ছুয়ে যাচ্ছে। আহা! কী আনন্দ! আকাশে বাতাসে।
হিমেল সবকিছু জানে বোঝে কিন্তু কিছু বলে না। তার বিশ্বাস ছোটোখাটো মতপার্থক্য থাকে একসময় এগুলো ঠিক হয়ে যায়। শ্রাবণী ঠিকই তার ভুল বুঝবে।
ইদের ছুটিতে হিমেল বাড়িতে আসে। শ্রাবণীকে বাড়িতে আসতে বলে, কিন্তু সে আসে না। কেননা তার নাকি স্কুল থেকে ইদের ছুটিতে ট্যুর আছে সেখানে সে যাবে। হিসাব কিছুতেই মিলতে চায় না। ছুটি শেষে হিমেল তার মাকে বাসায় নিয়ে আসে। মা ছেলের কি সুখের সংসার। কিন্তু মা বারবার ছেলেকে বলে বৌমাকে নিয়ে আয়…। আমরা সবাই একসাথে থাকি। বৌমা চাকরি করতে চায় এখানে এসে করুক। সমস্যাতো নেই। সংসারের যাবতীয় কাজকর্মতো এখনো আমিই করতে পারি। হিমেল কিছু বলে না। ঘাড় নারে আর বলে তোমার বৌমাকে তাড়াতাড়িই নিয়ে আসবো। কিন্তু মাতো জানে না তার বৌমার কাছে ছেলের কোনো মূল্যই নেই। হয়তো তিনি উপলব্ধি করেন। হিমেল কিছু বলে না। ঘাড় নারে আর বলে তোমার বৌমাকে তাড়াতাড়িই নিয়ে আসবো।
সময়ের তালে তাল মেলাতে মেলাতে শ্রাবণীর বন্ধু বিয়ের মিথ্যা প্রলোভনে তার জমানো সব টাকা আত্মসাৎ করে। টাকা ফেরত চাইতেই রঙিন জীবনের সম্পর্ক ধূসর হতে থাকে। যোগাযোগ কমতে থাকে। একসময় মোবাইলে স্থায়ীভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জীবনে চরম শিক্ষা হাতেনাতে পেয়েছে সে। ষোলকলায় পূর্ণতা পেয়েছে। হতাশার সাগরে সে হালবিহীন নাবিক। সকল আশ্রয় থেকে আজ যেন সে বিচ্ছিন্ন। মরিচীকার মাঝে ভেসে ওঠে তাঁর হাতে নির্যাতিতা শাশুড়ীর মুখ। মনে মনে ভাবে এতো টাকা পয়সা আত্ম অহংকার পার্থিব জীবনের জন্য কিছুই বয়ে আনে না। মোবাইল হাতে নেয়। প্রিয়স্বামীকে ফোন দিতে চায়… আবার ফিরে আসে। ভাবে স্বামীর বাসায় সরাসরি ফিরে যাবে। কিন্তু সেকি চিনবে সে বাসা? বিয়ের পর মনিপুরের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে যে বাসাটা ছিল? একবার সে গিয়েছিল হিমেলের সাথে! আর গেলেইকি সে গ্রহণ করবে আদরে… নাকি অচেনা ভান করে মুখ ফিরিয়ে নিবে? ওর মাতো আমারই মা। কত পরম মমতায় আমাকে খাইয়ে দিতে চাইতো… কত আদরে বুকে আগলে রাখতে চেয়েছিলো… টুম্পাকে কত রূপকথার গল্প শোনাতে চাইতো…? আরও হাজারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত সে টুম্পাকে সাথে নিয়ে রওনা হলো এক অনিশ্চিত জীবন বন্ধনের আশায়। বাসা চিনতে পারলে ভাল… না চিনলে হিমেলকে ফোন দিবে। যাবার পথে মায়ের জন্য কিনলো কিছু পান, স্বামীর জন্য কিনলো ঝুরিভাজা আরও পছন্দের কত কি? তারপর বাসার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকলো। অবশেষে গেটে আসতেই জানালা দিয়ে শাশুড়ী মাকে চোখে পড়লো। মনে হয় আমার জন্যই পরম মমতায় তিনি অপেক্ষায় করছেন। কোনো পরিবর্তন নেই। সেই আগের মতোই সাদরে গ্রহণ করলেন। কি বিচিত্র! এই পৃথিবীর মানুষ এতো সুন্দর হয় কি করে? আসলে মাতো মাই। মায়ের কোনো পরিবর্তন হয় না।
প্রতিদিনের মতো হিমেল বাসায় ফিরছে… বাসায় ফিরেই চক্ষু চড়কগাছ… তার প্রিয়তমা স্ত্রী তার পাশে, পাশে তার তনয়া। চোখ বন্ধ করলেন, আবার তাকালেন… না তিনি ঠিকই দেখছেন। একমুহূর্ত দেরী না করে কান্নায় ভেঙে পড়লো হিমেলের বুকে। আর এদিকে টুম্পা আবার লাফিয়ে কোলে উঠলো ওর দিদার…। চিৎকার করে বলে উঠলো,”দিদা পান দিবে না?”
তাপস বৈরাগী
মিরপুর, ঢাকা।