সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: ছুটির দিন ঘুম ভাঙ্গল একটা শব্দ মাথায় নিয়ে, শব্দটা হল “ছোটলোকি”। হালের এনালিস্টরা বলে থাকেন, মানুষ যা ভাবে তাই ই নাকি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মত তার মাথায় ঘুরতে থাকে।জেগে থাকাবস্হায় মাথায় চক্কর মারে,এমনকি ঘুমালেও তাইই স্বপ্ন দেখে। ছোটলোকি শব্দটি মাথায় নিয়ে উইকএন্ডের রাতে ঘুমাতে যাইনি-কিন্তু ঘুম ভেঙ্গেই দেখি শব্দটা মাথায় জাকিয়ে বসেছে। এ আমার এক পুরানো রোগ, হঠাৎ করে কোন একটা শব্দ, একটা গানের কলি, কবিতার ছন্দ, কোন উক্তি বা কোন ঘটনা হঠাৎ করে মাথায় ঢোকে এবং এটাকে মাথা থেকে বের করতে বেশ কসরত করতে হয়।
বিষয়টি নিয়ে কারো সাথে শেয়ার করা সে কসরতেরই একটা অংশ। ছোটলোকি শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও মূলত এর প্রায়োগিক রূপ হচ্ছে কৃপনতা, সংকীর্নতা, বখিলতা বা যেকোন ধরনের অনুদারতা। শব্দটিকে মাথা থেকে তাড়ানোর জন্য কয়েক মিনিটের আর এন্ড ডিও করে ফেললাম। শুক্রবারের বিকালে সেসব ভারী কথা বলে কাউকে ভারাক্রান্ত করতে চাইনা। ধর্ম নিয়ে আমার জ্ঞান এবং পড়াশুনা কম। পারতপক্ষে খুব একটা সে আলোচনায় যাইনা – নিজের সীমাবদ্ধতার কারনেই।
ছোটলোকি বা কৃপনতা সম্পর্কে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কোরআন হাদীসে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। তাই সামান্য একটু আলোকপাত করতে চাই-
১। তুমি তোমার হাত গ্রীবায় আবদ্ধ রেখোনা আবার তা সম্পূর্ণ প্রসারিত কোরোনা, তাহলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হবে। (সুরা বনি ইসরইল, আয়াত-২৯)
২। আর যারা প্রবৃত্তির লালসা ও মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত রয়েছে তারাই সফলকাম হবে। (সুরা তাগাবুন-১৮)
৩। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপনতা করে এবং এই কার্পন্য তাদের জন্য মংগল জনক হবে তারা যেন এমন ধারনা না করে। বরং এটা তাদের জন্য একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যেসব সম্পর্কে তারা কার্পন্য করে সেসব ধন সম্পদকে কেয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ি পরানো হবে। (সুরা ইমরান-১৮০)
একইভাবে হাদীসে এসেছে ‘‘কৃপন ব্যক্তি খোদা হতে দূরে, লোকসমাজে ঘৃনিত এবং দোযখের নিকটবর্তী। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) হতে বর্ণিত আছে, কৃপণতা ও বদ স্বভাবের লোকদের সাথে মুমিনরা একত্রিত হতে পারেনা। (তিরমিজি)
একইভাবে সূরা মুহাম্মদ আয়াত-৩৮, সূরা হাদিদ আয়াত-২৪, সূরা বনি ইসরাইল আয়াত-১০০, সূরা নিসা আয়াত-৩৭, সূরা তওবা আয়াত ৩৪/৩৫ – এ কৃপনতা বা সংকীর্ণতা সর্ম্পকে বর্ননা করা হয়েছে। যার সারসংক্ষেপ হল বখিলতা, কৃপনতা, অনুদারতা প্রচলিত অর্থে যা ছোটলোকি হিসাবে পরিচিত কোরআন হাদীসের আলোকে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় এমন কি অন্যান্য ধর্মের ভাষ্য অনুযায়ীও তা সর্বতভাবেই পরিত্যাজ্য।
ছোটলোকি করে খুব যে লাভ হয় তা কিন্তু নয় বরং এটি এক ধরনের মানসিক বিকৃতি যার পরিনাম সামাজিক বা পারিবারিক জীবনে তো বটেই এমনকি ব্যক্তি জীবনেও অত্যন্ত ক্ষতিকর রূপে দেখা দেয় প্রায়শই।
কথায় আছে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্য্যন্ত। আমি যেহেতু জাতিতে পুলিশ তাই কোন বিষয় ঠিক মাথায় ঢুকলে অন্যবিধ দৃষ্টি ভংগীর পাশাপাশি পুলিশী দৃষ্টিভংগীতেও ঘটনাটির বিশ্লেষনের চেষ্টা করি, কারন সেটাই আমার কাছে সহজ। মোল্লাগোষ্ঠীর এক ভদ্রলোক কথা প্রসংগে আমাকে একদিন বলেছিলেন আচ্ছা ভদ্রলোকেরা এই যে মোল্লাদেরকে নিয়ে তাদের দৌড় মসজিদ পর্য্যন্ত বলে কটাক্ষ করে তার কি কোন যৌক্তিকতা আছে? মসজিদ অর্থ্যাৎ আল্লাহর ঘর পর্য্যন্ত যার দৌড় তার কি আর কোথাও যেতে বাকী থাকে? যাক সে বিতর্কে না যাই। ছোটলোকি নিয়ে পুলিশী জীবনের একটা গল্প বলে শেষ করি, সেটাই বরং আমার জন্য সহজ।
সম্ভবত ২০০১/২০০২ সালের ঘটনা। আমি তখন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মজীবন সবে শুরু করেছি, সহকারী কমিশনার হিসাবে। মাস ছয়েক এসি ফোর্স, ট্রাফিক, সিটি এসবি এসকল দায়ীত্ব পালনের পর পোস্টিং হয় এসি (খুলনা জোন) হিসাবে। দায়ীত্বাধীন এলাকা তৎকালীন বৃহত্তর খুলনা ও সোনাডাঙ্গা। থানা এলাকা, যা খুলনার প্রাণকেন্দ্র। অতিরিক্ত দায়ীত্ব এসি ডিবি, যার দায়ীত্বাধীন এলাকা সমগ্র খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকা। খুলনা শহরে তখনো একটা গ্রামীন আবহ ছিল। বিশেষ করে নিরালা,গল্লামারি, বয়রা, রূপসা, আড়ংঘাটা,বয়রা,দৌলতপুর,শিরোমনি সহ নদী বা বিলের তীরবর্তী বিস্তীর্ন জনপদ ছিল নীচু এলাকা, কোথাও রাস্তাঘাট আছে, কোথাও নাই, কোথাও ঘরবাড়ী আছে, কোথাও কোথাও ফাঁকা এবং কোথাও কোথাও নির্মানাধীন।
স্বল্প আয়ের মানুষ খন্ড খন্ড জমি কিনে বাড়ী করে থাকে, একতলা, দোতলাই বেশী, কোথাও কোথাও সেমিপাকা বা টিনশেড। এসব এলাকার ভাড়াটিয়ারাও মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। অনেক এলাকাতেই বর্ষায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতো, কোথাও কোথাও নৌকায়ও যাতায়াত করতে হত।
সম্পদ সবার কাছেই অনেক মূল্যবান, এসব এলাকায় বসবাসরত নিম্ন মধ্যবিত্ত লোকজনদের কাছে আরো বেশী। অধিকাংশই ছোটখাটো চাকরি বা ব্যবসা করে, সম্পদ এদের কাছে স্বপ্নেরই আরেক রূপ। যার বাড়ী একতলা সে হয়তো দোতলা করার জন্য টাকা জমাচ্ছে। জমানো টাকা আরেকটু বাড়লে যৎসামান্য সোনা দানা যা আছে তা বিক্রি করে ধার-দেনা করে দোতলায় হাত দিবে।
৮/১০ বছরের ভাড়াটিয়া হয়তো একশ/ দুশো টাকা করে ৮/১০ বছর ধরে টাকা জমাচ্ছে একখন্ড কম দামী জমির আশায়, তারও স্বপ্ন আর ভাড়াটিয়া নয় একখন্ড জমি হলে দরকার হলে দুখানা টিনের ঘর করে থাকবে। তারপর একসময় একতলার ছাদ, দোতলার ছাদও হবে। বাড়ী ওয়ালার বউ এর মত সেও ছাদে গিয়ে চুল শুকোবে। ভাড়াটিয়াদেরকেও ছাদে যেতে দিবে, তার বাড়ীওয়ালির মত করবে না।
কেউবা মুদিখানার দোকান করবে, তার স্বপ্ন কম দামে নিজের একটা দোকান কিনবে, তারও আর ভাল লাগেনা পরের দোকানে ভাড়া থাকতে, মাসে মাসে ভাড়া গুনতে। এমনি ছোট ছোট স্বপ্ন নিয়ে ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ছোট ছোট বাড়ীতে এসব লোকজন বাস করে। তাদের ছোট ছোট জমানো সঞ্চয়ের দিকে কুনজর পড়ে পেশাদার অপরাধীদের। প্রায় প্রতি রাতেই নৌকায়, পায়ে হেঁটে ব অন্যান্যভাবে ৫/৭ জনের ডাকাত দল হানা দেয় এসব ঘর বাাড়ীতে। নগদ টাকা, সোনা দানা ছাড়া আর কিছু নেয়না।
প্রতি রাতেই এরকম ৫/৬ বাড়ীতে ডাকাতদের হানা পড়ে। মানুষগুলো সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। তাদের দীর্ঘ দিনের জমানো সঞ্চয়ের সাথে নিঃশেষিত হতে থাকে অনাগত দিনের স্বপ্নগুলোও। বেশীর ভাগই থানা পুলিশ করেন
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
এডিশনাল ডিআইজি, এন্টি টেররিজম ইউনিট, বাংলাদেশ পুলিশ