পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে যে অসন্তোষ আছে, তার মূল কারণ বৈষম্য। শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক সেবা পাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে সমতলের তুলনায় পাহাড়ি জনগণের বঞ্চনার বোধটাও দীর্ঘ। রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি তার চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত।
প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির যে হতশ্রী চিত্র পাওয়া যায়, তার সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত কোনো জনপদের স্বাস্থ্যসেবার মিল পাওয়া যেতে পারে। রোগী, চিকিৎসক, ওষুধের খালি বাক্স, ফার্মেসি, ল্যাবরেটরি, গুদামঘর, তিন কক্ষের টিনশেড ভবনে চলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। পরিত্যক্ত আরেকটি ঘর ব্যবহৃত হচ্ছে জরুরি বিভাগ হিসেবে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে এখন মাত্র চারজনকে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব। তা–ও আবার মেঝেতে রেখে। অথচ প্রতিদিন সেখানে চিকিৎসা নিতে আসেন কমপক্ষে ৬০-৭০ জন রোগী। পাহাড় ডিঙিয়ে, নদী পেরিয়ে পাহাড়ের পল্লিগুলো থেকে তাঁদের উপজেলা সদরে আসতে কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। আর এসে যখন জায়গা সংকুলান না হওয়ার কারণে তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, এর চেয়ে বড় বেদনার ঘটনা আর কী হতে পারে। বাধ্য হয়ে উপজেলা থেকে নৌকায় তিন ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যেতে হয় তাঁদের।
এ বাস্তবতা শুধু চিকিৎসা ব্যয়ই বাড়াচ্ছে না, দুই ধরনের ঝুঁকিও তৈরি করছে। এক. অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে বিমুখ হচ্ছেন। দুই. প্রাথমিক অবস্থায় রোগের চিকিৎসা না হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সংকট তৈরি করছে।
জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ সংকটের পেছনে রয়েছে অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত জটিলতা। ২০২৩ সাল থেকে উপজেলাবাসী স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এমন দুঃসহ ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ১০ শয্যার পুরোনো হাসপাতাল ভবনটি ভেঙে ৫০ শয্যার নতুন হাসপাতাল ভবন তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়। নির্মাণ প্রকল্পটি ৫০ শতাংশের কাজ শেষ হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি লাপাত্তা। সেই থেকে কাজ বন্ধ।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে, পুরোনো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। নতুন প্রকল্প অনুমোদিত হলেই তারা দরপত্র আহ্বান করবে। প্রশ্ন হলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা জানা সত্ত্বেও কেন দরপত্র আহ্বানের জন্য এক বছর বসে থাকা হলো। কেন এমন আমলাতান্ত্রিক চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা গেল না?
রূঢ় বাস্তবতা হলো জুরাছড়ির বেশির ভাগ এলাকা দুর্গম হওয়ায় কেউ হেঁটে অথবা কেউ কাঁধে করে রোগী নিয়ে আসেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তাঁদের অনেককেই চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। আমরা মনে করি, জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা প্রয়োজন। প্রান্তিক ও দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত করা যাবে না